করোনাকাল

0
1740

করোনাকাল

নয়ন তানবীরুল বারী

আম্মা যখন ইন্তেকাল করলেন আমরা পাঁচ বোন তখন ছোট। যদিও আমি সকলের বড়, ভাই নেই। ক্লাস এইটে পড়ি। এক্ষেত্রে পুরুষরা আবার বিয়ে করে। বলা বাহুল্য আমার বাবা পুরুষ ছিলেন। এরপর কিভাবে বেড়ে উঠেছি সেটা বাংলা মুভিগুলোতে আছে।
এসএসসি দেওয়ার পর থেকেই আমার বিয়ে দিয়ে দেওয়ার জন্য বাবার আপ্রাণ চেষ্টা। বুড়া, টাকলু, আর্মি, বিডিয়ার,দোকানদার, কলেজের লেকচারার, প্রবাসী কেউ বাদ যায়নি যে আমাকে ঘোমটা পড়ে দেখেনি। পাত্র কত প্রকার ও কি কি যাকে বলে।
সরকারি কলেজে দ্বিতীয় বর্ষেই শেষ পর্যন্ত আমার বিয়েটা হয়ে যায়। ছেলে ঢাকায় একটা বেসরকারি কোম্পানিতে জব করে। কোন কোম্পানি? কত বেতন? চাকরির ধরণ? চাকরির স্টাবিলিটি? এসব জানা বা বুঝার আগেই বিয়েটা হয়ে গেলো। কিছুদিন পরেই ছোঁ মেরে ও আমাকে নিয়ে তুললো ছয়তলার ছাদে। ঘর বলতে একটা করে সব! মানে একটা রুম, একটা ড্রয়িং রুম, একটা বেলকনি, নিতান্তই ছোট একটা বাথরুম তারচেয়েও আশ্চর্য ছোট একটা কিচেন।
ঘরে আসবাবপত্র বলতে একটা কেরোসিন কাঠের ওয়ারড্রব আর একটা প্রকান্ড বুকশেলফ! অথচ একটা খাট নেই! এর শানে-নুজুল কিছুই বুঝলামনা। সারারাত জার্নির পর, ও আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে বিদ্যুৎগতিতে গোছল করে অফিস পানে গোল্লাছুট!
এতো অবাক বোধ হয় ছোট বেলায় লুকিয়ে অন্যের বাসায় “আলিফ লায়লা” দেখার সময়ও হইনি।
ও চলে যাবার পর একাকী বাসায় কত কিছুই না ঘিরে ধরলো! কত স্মৃতি! কত ঘটন অঘটন!
অজানা অচেনা পরিবেশ! কাল কোথায় ছিলাম আর আজকে কোথায় এলাম! কার সাথে এলাম।
সারাবাড়ি ধূলায় ধূসরিত। ছড়ানো ছিটানো বইপত্র, কত রকম পত্রিকা, ম্যাগাজিন! আস্তরণে বন্দী। কলেজজীবনে লেখক বলতে নজরুল, রবীন্দ্রনাথ, শরৎ, সমরেশ, হুমায়ুন আহমেদ এদেরকেই বুঝতাম। এখন ঘরে দেখছি আহমদ ছফা, বদরুদ্দীন উমর, আহমদ শরীফ, শহীদুল জহির, মাহমুদুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখ নাম না জানা কত লেখক! পাগলটাগলের পাল্লায় পড়লাম নাকি!
ঘরদোর পরিস্কারের করে, বইপত্র গুছিয়ে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম কিছুই বলতে পারছিনা।

সম্পূর্ণ অজানা অচেনা একটা পুরুষ। পূর্ব প্রেম ছাড়াই তার সাথে হঠাৎ একসাথে বসবাস! এগুলো খুব ভাবাতো। আবার মনে করেন ছেলেটি দেখতে কেমন হবে? ও আগে কারো সাথে ইটিসপিটিস করেছে কিনা? কি খেতে পছন্দ করে? ধূমপান জাতীয় কোন নেশাটেশা আছে নাকি? এ রকম কত ভাবনাই যে একসময় আসতো! একপ্রকার ভাবালুতা আরকি!
আজ এসব ভেবে হাসিই পায়!
কতই তো দেখলাম প্রেমের বিয়ে! কতই না দেখলাম প্রেম ছাড়া বিয়ে! কোনটা যে টিকে আর কোনটা টিকেনা কেউ বলতে পারে কি? মিথিলাকে নিয়ে কি কান্ডটাই না হলো! অবশ্য শোবিজের এগুলো হরহামেশাই শোনা যায়!
পারফেক্ট বলতে কিছু হয়কি? শেষ পর্যন্ত দুটো মানুষ ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা নিয়ে রেললাইনের মতো এগিয়ে চললেই হয়। এতো ছোট্ট একটা জীবন মানুষের! পার তো হয়েই যায়।
দেখতে দেখতে বিয়ের সাত বছর হয়ে গেলো। ওর প্রাইভেট চাকরি যায় আর আসে। আবার নিজেও ছাড়ে। কখনো অফিসের সিস্টেম ভালো না, কখনো বসটা সুবিধার না।
তাই আমাকেই ও চাকরিতে ঢুকিয়ে দিলো। সরকারি চাকরি তো হলোনা, হবেও না। দলীয় লোক আর পাত্তি ছাড়া কোন কথাই নেই। তারপর আবার চ্যানেলটাও ঠিকঠাক লাগে। সরকারি চাকরির বেতন বেড়ে যাওয়ায় চাহিদাও বেড়েছে। ব্যাংকও খারাপ না। অন্তত ঢাকায় বাড়িটা হয়ে যেতো এতোদিনে। এখন ব্যাংকগুলোও আনস্টাবল। কীসব অদ্ভূত আর নতুন নতুন আইন করেছে। কখন যে কোনটার ঝাপ বন্ধ করে দেয় বলা যায়না।
দেশের প্রথম সারির একটা আইটি কোম্পানিতে চাকরি করছি দুবছর হতে চলল। আউটসোর্সিং বলতেই অনেকে মনে করেন ডলার আর ডলার। আসলে ঘটনা ততটা নয়। ওরকম খুব বেশি হয়না। আর আমি আউটসোর্সিং এর কাজটা করছি চাকরি হিসাবে। বেতন আহামরি কিছু নয়। দুজনের খাওয়া খরচটা হয়ে যায়। এটাই বা কম কিসের! ওর তো চাকরির নিশ্চয়তা নেই। কখন ধরে আর কখন ছাড়ে! মজার বিষয় হলো ওর যখন চাকরি থাকে তখন একরকম আর চাকরি ছাড়া আরেক রকম হয়ে যায়।
যে মানুষটা আমার ঢাকা বলতেই অজানা আতঙ্ক কাজ করতো আর ঢাকায় ঢুকে মেয়েদের কাপড়চোপড় দেখে নিজেই লজ্জা পেতাম আজ সে পুরাদস্তুর প্রফেশনাল। ঘুম থেকে যে মানুষটা সকাল এগারোটায় উঠতো কখনো কখনো আজ সে সকাল পাঁচটায় ঘুম থেকে উঠে মেয়ের জন্য খিচুড়ি রাঁধি। ঘরদোর ঝাড় দিয়ে, গোসল করে অফিস রওনা দেই। সকাল সাতটায় ফিঙ্গার প্রিন্ট। তিনদিন লেট হলে একদিনের সেলারি কাঁটা। অথচ আমি একজন আদর্শ গৃহিণীই হতে চেয়েছিলাম। কেউ আমাকে আগলে রাখুক। ভালোবাসুক। খুব কেয়ার করুক। আর আমি আঁচলে চাবির রিং বেঁধে, পান চিবিয়ে মুখ লাল করে পাক্কা সংসারী হয়ে থাকবো।
আহা সংসার! আহা সঙ সার মোর!
তবে একজন চাকরিজীবি মেয়েকে কিন্তু সংসার আর চাকরি দুটোই করতে হয়। আর ছেলেরা অফিস থেকে বাসায় পৌঁছে পোশাকও ছাড়তে চায়না। বসে যায় রিমোট নিয়ে। এখন অবশ্য সেই সুযোগ কমে গেছে। কেননা রিমোট আজকাল কার্টুন দেখনেওলার দখলে।

দেখতে দেখতে মেয়েটা বড় হয়ে গেলো। বয়সের তুলনায় হাতেপায়ে বাড়ন্ত। একদিন ঘরে ফিরে কলিংবেল টিপে অপেক্ষায় আছি। মেয়ে দরজা খুলে দিয়ে ” মাম্মি” বলে চমকে দিলো! মেয়ে আমার কাজল, লিপস্টিক, চুড়ি পড়ে সেজেছে। (ওর খালামনির কাজ) মুখে একটা হাসি। ওরে আমার মামনিটা! খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে। বলে জড়িয়ে ধরি। থ্যাংকু মাম্মি বলে হাত বাড়িয়ে থাকে। অফিস থেকে যেই ফিরুক ওর জন্য কিছু একটা আনতেই হবে।
বেশ রাত করেই ওর বাবা ফিরলে, বিছানায় হেলান দিয়ে মেয়ের ছবি দেখাই মোবাইলে। মেয়েই তুলেছে সেলফি। এখানে বলে রাখি যে, খুব ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ইউটিউব আর বাহিরের খাবার থেকে মুক্ত রাখতে পারিনি ছবি দেখে ওর বাবা বলে, মেয়ে তো দেখছি বড় হয়ে গেছে! খুব সুন্দর লাগছে তো!
-হম! কিন্তু এতো সুন্দর তো সুন্দর না গো! বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। মেয়েরা তো আজকাল কোথাও নিরাপদ না। কোন পরিবেশই তো নাই দেশে! কি রাস্তাঘাটে! কি পরিবারে? কি বন্ধুবান্ধবের কাছে? কি কর্মস্থলে!
– সেটাই তো! বলে চুপ থাকে ও।
-বুলবুলে গেছিলা আজকে? আবৃত্তির ক্লাস কয়টায়?
ওকে বিমর্ষ দেখায়! আমি আবার জিজ্ঞেস করি কি হলো?
-না। এখন আর ভর্তি করাবো না। অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। এ সময় বাড়িতে থাকাই ভালো। আর শুনো ওকে নীচে নামতে মানা করিও। পার্কেও যেন না যায়! ডিশের লাইনটা সরিয়ে রাখছো তো?
আমি হতবিহ্বল হয়ে জিজ্ঞেস করি।
কেন গো সিচুয়েশন কি বেশি খারাপ?
সে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তাকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। আমি নিকটে গেলে তার কাঁধে মাথা গুঁজে নিজেও ভেঙে পড়ি। সিচুয়েশন তো আমিও জানি। উপরে উপরে সকলে তাল মিলিয়ে চলছে। কেউ মুখ ফুটে কিছু বলছেনা। কিশোর আন্দোলনের সময় একটা কথা খুব ছড়িয়েছিল- “নাম বললে চাকরি থাকবেনা”। আর সিসিটিভি, নজরদারি, ফোনে আড়ি পাতা এগুলো নাকি খুব বেড়েছে।
সে কিছু বলছেনা দেখে আমি বলি – শোন সারাদিনের আপডেট হচ্ছে তোমার গুণধর বোন আজকেও ফোন করেছিল! আরেকটা বাচ্চা নিচ্ছিনা কেন? নাদিয়া তো বড় হয়ে গেলো। তুমিও মোটু হয়ে যাচ্ছ। ঐ একই রবীন্দ্র সঙ্গীত!
আরেকটা কথা হচ্ছে, মেয়ে আজকেও জিজ্ঞেস করেছিল বাহিরে যাওয়া যাবেনা কেন? ডিশের লাইনটাও ঠিক করছ না।
একদিন বললাম বাহিরে হেলোইন, আরেকদিন বললাম বাইরে দুষ্ট মানুষ! গতকাল বলেছি বাইরে গেলে পুলিশ মারবে! আজকে বলেছি বাহিরে সেনাবাহিনী নেমেছে!
এভাবে আর কত? মেয়ের কাছে সত্যিটা লুকানো কি ঠিক হচ্ছে! ঘরে থেকে থেকে ও তো বোরিং হয়ে গেছে। তারচেয়ে ওর দাদাদাদীর কাছে পাঠিয়ে দিলেই ভালো হতো! তোমার মেয়ের যা রাগ! আজকে নাকি রাগারাগি করে ওর প্রিয় পুতুলটার চুল ছিড়ে ফেলেছে।
ঘড়িতে রাত দুইটা বাজার আওয়াজ হয়। কারও ঘুম আসেনা। দুজনে দুজনার মতো ফেসবুকে ঢুকে যাই!

কি হলো আজ এই শহরের! উন্নয়ন কর্মকাণ্ড সব বন্ধ। বাস-কার-সিনজি-পণ্য ডেলিভারির গাড়ি সব উধাও! বড় কারুকাজ করা দালানটার সামনের নারিকেল গাছটাতে একটা দাঁড়কাক উদাস গলায় ডাকছে। দোকানপাট সব বন্ধ। প্রতিদিনের ব্যস্ত শহরটাকে মনে হচ্ছে পরিত্যক্ত ও অভিশপ্ত কোন প্রাচীন নগরী। এত বড় বড় শপিংমল, সিনেপ্লেক্স, মদের দোকান, বাহারি তৈজসপত্রের দোকান, নানা রঙের ও নানা রকমের চায়নিজ বেলুনের ফেরিওয়ালা, ফুচকা আর চটপটির দোকান, ফুটপাতে চাঁদা দিয়ে টিকে থাকা কাঁচাবাজার, মুঠোফোন সামগ্রীর দোকান, মেয়েদের এটাসেটা বিক্রি করা নানা রকম পণ্যের দোকান, বাদামওয়ালা, কাঁচাকলার ভর্তা বিক্রি করার যুবক, বাসের ভেতরে বিক্রির জন্য পানীয় বিক্রেতা কোথাও কেউ নেই! নেই কোনরকম হৈচৈ! কোলাহল! এমনকি হাততালি দিয়ে যেসব হিজড়ারা আক্রমনাত্মক ভঙ্গিতে দশটাকা দশটাকা করতো তারাও কোথায় হারিয়ে গেলো! কোন অতল গহ্বরে! বুকটা ধুকধুক ধুকপুক করছে। ভূত এফএম এর প্রেতাত্মারা যেন জেগে উঠেছে। প্রাণহীন শুনশানে হঠাৎ হাওয়া লেগে পতপত শব্দ করে উঠে ভোট চাওয়ার পোস্টার আর ব্যানারগুলি। ভয় আর আতঙ্কে শরীরের পশম খাঁড়া হয়ে উঠে।
অনেকক্ষণ চেনা শহরের অচেনা রূপ পরখ করতে করতে একটা রিকশা পেয়েই উঠে পড়ে। ভাগ্যক্রমে যাত্রী পেয়ে হয়তো “কই যাবেন” বলে জানার প্রয়োজন মনে করেনি রিক্সাওয়ালা।
যে কাবাব-বিরিয়ানি আর শর্মা-পিজ্জার দোকানগুলোর সামনে শুয়োরের মতো মোটাসোটা কয়েকটা কুকুর ঘুরাঘুরি করতো, সেগুলোর বুকের পাঁজর বেরিয়ে এসে কুইকুই করছে। সড়কের পাশে ভাঁটফুলগুলো সুবাস ছড়াচ্ছে। ধূলার আস্তরণ সরে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে সবুজ আভা! কি আশ্চর্য! দুর্নীতি করা ফাটা সড়কের মাঝ বরাবর সগর্বে দুর্বিনীতভাবে গজিয়ে উঠেছে বুনো ঘাস!
বড় মাঠটার সামনে কিছু খাদ্যসামগ্রী আসতেই ভাম্পায়ারের মতো হামলে পড়লো সহস্র লোক। ওদিকে কালো রঙের গাড়ি থেকে একটা ফর্শা হাত মুঠো মুঠো টাকা ছড়িয়ে দিলেও খুব কম লোকেই এগিয়ে যায়। কেননা টাকা দিলেই যে, খিচুড়ি পাওয়া যাবে এমন নিশ্চয়তা নেই!

দুজনেই চাকরি করছি। একজনের বেতনে ভালো চলা যায়না। যা বাড়ি ভাড়া। সকালে উঠেই দুজন দুই দিকে। যেন কেউ কাউকে চিনি না। কী দ্রুততার সাথেই না প্রস্তুত হতে হয়। না হলে বাস মিস। তারপর যেন অবধারিত একের পর এক সমস্যা।
একই রকম ফ্রেমে বাঁধা দিনরাত-মাস-বছর।
বিয়ের পর আজ পর্যন্ত কোন ফুরসৎ হয়নি। ভালোবাসার সময় নেই। রোমান্স নেই। ভয়ানক এক রুটিন জীবন।
আজ বাড়ি থেকে ছোট দেবর জুলফিকার ফোন করেছিল। হাসপাতাল থেকে ব্লাড নিয়ে গেছে। ঢাকা থেকে ও অনেক আগেই গেছে। জ্বর-সর্দি আর গলাব্যাথার বিষয়টা কিভাবে যেন জানাজানি হয়ে গেছে। বলল -ভাবি আমার বিশ্বাস আমার করোনা হয়নি। আমি তো কয়েকজন মিলে সাবান-চাল-ডাল বিতরণ করতাম। সৌরভ তো পঞ্চসেবা নামে সংগঠন করে বাড়ি বাড়ি নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছে দিয়ে আসছে। কতজনের কতরকম চেষ্টা। আমাদের কিছু হবেনা। ভাবি তুমি দেখে নিও। শুধু দুঃখ কি জানো জ্বর হওয়ার পর গ্রামের লোকজনই নানা কথা বলে বেড়াচ্ছে। ওর গলা ধরে এসে বুঝা যায়। জানো ভাবি জলিল ভাই ইতালি থেকে আসছে শুনে অপু ভাবি পালিয়েছে। হা! হা! হা!
সময়টা খারাপ যাচ্ছে না। লুডু খেলছি। দাবা খেলছি। এমনকি একসাথে নামাজও পড়ছি। মেয়েটা ছোট্ট সবুজ জায়নামাজটাতে সেজদা দেওয়ার সময় সবার আগে গিয়ে পাশ ফিরে দেখছে। নামাজ ছেড়ে পিঠে ঘোড়ার মতো উঠে – “নেই! নেই! (neigh)” বলে খুশিতে আটখান হয়ে যাচ্ছে। বুয়াকে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। যে মানুষটা কোনদিন সংসারের কোন কাজই করতোনা, সে মানুষটা কোনদিন থালাবাসন ধুয়ে দিচ্ছে। স্বপ্ন, আগোরা কিংবা প্রিন্স থেকে সদাই করছে। ব্যায়াম হচ্ছে বলে ঘরও মুছে দিচ্ছে। ডাউনলোড করা ভিডিও দেখে দেখে সবাই হালকা ব্যায়াম করছি। ভিটামিন সি আর জিংক যুক্ত খাবার খাচ্ছি। মেয়েটার ইউটিউব আসক্তি কমেছে। ওর বাবা নিয়মিত ওকে পড়তে বসাচ্ছে। বার্থডেতে জমে থাকা খেলনা গুলো বের করে খেলায় মেতে উঠছে। আমিও নিজে রান্না করে খাওয়াচ্ছি। একদিন নুনপুড়ি বানিয়ে খেলাম। কম করে খাবো চিন্তা করেও কম খাওয়া যাচ্ছে না। তরকারি এমন মজা হচ্ছে যে না খেয়ে থাকা যাচ্ছে না। এ সময় খাবার নিয়ে খুব একটা সংকট যাচ্ছে জেনেও। এই অপরাধবোধ তো আছেই। ও তো কয়েকটা গ্রুপে চাঁদা দিয়েছে। এছাড়া আর আমরা কীই-বা করতে পারি।
ফেসবুকে অনেকে ক্ষমা চেয়ে স্ট্যাটাস দিচ্ছে। শীঘ্রই এই সিচুয়েশন কাটছে না বোধ হয়।
ডিশের লাইন, নেটের লাইন কেটে দেওয়ার দিন মেয়েটা খুব কান্নাকাটি করছিলো। আমি ওকে একফাঁকে বিষয়টি নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। কোথায় কি হচ্ছে না হচ্ছে কিছুুই তো জানতে পারবোনা। পত্রিকাটাও বন্ধ করে দিলে। ও বলল – সারা বিশ্বে এই হাজার হাজার মৃত্যু। ভূতের মতো পিপিই পড়া লোকজন। লাশ দাফন। যেখানে সেখানে মরে পড়ে থাকা মানুষ। বিজ্ঞানের এই অসহায়ত্ব। মানুষে মানুষে এই দূরত্ব। তুমি চিন্তা করছো? নিজের হাতকেই মানুষ বিশ্বাস করছেনা। তোমার হাতই হয়ে যাচ্ছে তোমার মৃত্যুর কারণ।
এগুলো এ দেশও শুরু হয়ে যাবে। আমাদের উন্নয়ন তো লোক দেখানো। আছে আমাদের কোন প্রস্তুতি? নেপালের দিকে দেখো ওদের ওখানে করোনা পাওয়াই যায়নি তবুও ওরা প্রস্তুতি নিচ্ছে। উচ্চ পর্যায়ের লোকজন কীসব বলছে! ফেসবুকে তো সেদিন দেখলাম একজন লিখেছেন -চীনের আছে আলী বাবা আর আমাদের চল্লিশ চোর!
এগুলো দেখে আমাদের মেয়ে বড় হবে এটা বাবা হিসেবে কীভাবে চাইতে পারি আমি?
আর কথা আগায়না। হঠাৎ দখিনা জানালাটা দিয়ে শীতল একটা বাতাস ঢুকে ঘরে। আমি জানালার কাছে গিয়ে গ্রিল ধরে বাইরে তাকাই। বাইরে আমগাছটায় খুব মুকুল হয়েছে। বাইরে প্রকৃতি তারপরও নিজের মতো সেজেছে। যেন পৃথিবীতে মানুষ অপরিহার্য কিছু নয়।
দেরি হয়ে গেছে এমন চমকে গিয়ে ও বলে উঠে – “লায়লা! লায়লা! ! বাতাস আসছে! বাতাসেও থাকতে পারে জীবানু! সবকটা জানালা বন্ধ করে দাও!”

নারীকেল গাছের পাতা নাকি সাদা সাদা হয়ে গেলো। চারদিকে একটা আতঙ্ক। বেঁচে থাকার কতই না চেষ্টা মানুষের। কখনো থানকুনি পাতা, কখনো মধু কখনো কালিজিরা আবার কখনো ফেক্সোফেনাডিন কখনো ভিটামিন-সি, জিংক একেকবার একেকটার সোরগোল। বাজার থেকে উধাও। কি খেলে কি হবে এসবই নিত্য আলোচনা। আসহাব কাহাবের মতো কয়জন মানুষ আর কয়টা কুকুর! তর্ক-বিতর্ক। এদিকে কয়েকদিন বন্ধ যেতে না যেতেই গার্মেন্টস খোলার ঘোষণা এলো। কুরবানির গরুর মতো জবাই হতে প্রবেশ করতে হলো নগরে অসহায় মানুষকে। এর দায়ভার কেউ নিলোনা।
ইতালিতে ব্যালকোনি টু ব্যালকোনি উচ্চস্বরে গান গেয়ে জীবন উদযাপন করছে মানুষ আর সময়টাও পার করছে।
সন্ধ্যা হলেই গৃহপালিত হাঁস-মুরগি-গরু-ছাগলের মতো ঘরে অবস্থান নিচ্ছে মানুষজন। অনেকেই গ্রামে চলে গেছে। ডাক্তাররাও নাকি চিকিৎসা দিবেনা। আব্দুর নুর তুষারও পরিস্থিতি উত্তপ্ত করে। মুন্সিদের প্রলাপে ইউটিউব ছেয়ে যায়। জয়নাল হাজারীও চিকিৎসা নিয়ে হাজির হয়। কেউ কেউ আবার গ্রেফতার হয়, কেউ হয় চাকরিচ্যুত। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযোগ গুজব ছড়ানো হয়েছিল। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে সরকারের সমালোচনাই আসল কারণ। দুনিয়াজুড়েই নাকি বাকস্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। হঠাৎ একদিন রাত করে প্রতিটি বিল্ডিং থেকে আজান দেওয়া শুরু হলো। কখন কি হয় বলা যায়না।
কোন চালোশব্দ নেই। বড় বড় এপার্টমেন্টের অনেক ঘরগুলোতে বাতি জ্বলে না। পুলিশের পাশাপাশি আর্মি নামলে আরো নিস্তব্ধতা নেমে আসে।
এদিকে অফিসে কাজ কমে আসে। আশংকা মনে মনে চাকরিটা বোধহয় থাকবেনা। গুঞ্জনও উঠে। এভাবে কয়েকদিন। চাচাতো বোনের বিয়েতে ও যে একটা ঘড়ি কিনে দিয়েছিল তার খুব তারিফ চলে কয়েকদিন। না, আসলেই ঘড়িটা অনেক সুন্দর। কিন্তু আজ যে নতুন একটা শাড়ী পড়ে অফিসে এসেছি, সেটা কেউ বলছেনা!
ধাতব পদার্থ দিয়ে তৈরি বলে ঘড়িটা খুলে এসেছি। খুব খালি খালি লাগছে। একদিন সত্যি সত্যি বলে দিলো অফিস বন্ধ। পঁচিশ পার্সেন্ট বেতন পাবেন তিনমাস ঘরে বসে। তারপর পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হলে, চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হবেনা।
এজন্যই লাখ-লাখ টাকা দিয়ে, জমি জায়গা বিক্রি করে, যৌতুক নিয়ে বিয়ে করে, যে যেভাবে পারে সরকারি চাকরিতে ঢুকে পড়ে শিক্ষিত মানুষ। কোন পদের চাকরি সেটাও বিবেচ্য নয়। তারা হয়তো ঠিকই করে।
সবজির দাম কমে যায়। গ্রামেও চারপাঁচটাকায় সবজি বিক্রি হচ্ছে। দুধ মাটিতে ফেলে দেওয়ার ছবি পাওয়া যায়। তবে চিনি, বেসন, ছোলা মুড়ির দাম বাড়তি। সামনে রমজান বলেই কি? এদিকে করোনার রোগীর চেয়ে চালচোর বেড়ে গেলো হঠাৎ।
মৃত্যুর সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যায় সারা বিশ্বে। গণকবর দেওয়া হচ্ছে। এটিএম আজহারুলের ফাঁসি কি হয়ে গেলো? বঙ্গবন্ধুর খুনির ফাঁসি যে কোন সময়। রেদোয়ান রনি দাবি করেছে – “করোনার পরে ক্যাপ্টেন মাজেদের ফাঁসি কার্যকর করা হোক। যাতে করে তার লাশের উপর কিংবা লাশবাহী গাড়িটার উপর জুতা নিক্ষেপ করতে পারে।”
ছুটি বাড়তেই থাকলো। দিন আর দিন নেই, রাত রাত নেই। বার আর বার নেই। কি বার? কয় তারিখ কিছুই বলতে পারছিনা। এমনকি এলার্ম দেওয়ারও প্রয়োজন হয়না। হা! সময়!
মা-বাবা খুশি, টিভিতে ক্রিকেট হয়না। দেবরও খুশি স্টার জলসায় নতুন কোন পর্ব নেই। ফোনে এসব হাসতে হাসতে ভাগ্নি তাকিয়া জানালো। টিভিতে বিরক্ত হয়ে গেলো সকলে। যদিও প্রথম প্রথম ছুটিটা ভালই লাগছিলো।
বাড়িতেও মেয়েটা ক্রমশ অস্থির হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝেই রেগে যাচ্ছে। সারাদিন রান্নাবান্না আর ভালো লাগেনা। মেয়ের বাবাও বইমেলার বইগুলো বের করে আর উল্টেপাল্টে রেখে দ্যায়। মাঝে মাঝে ব্যালকোনিতে গেলে আমি চা দিয়ে আসি। একদিন বললাম – পড়তে ভালো না লাগলে, লিখতে তো পারো! জবাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল – লেখালেখি বলো আর জীবনযাপন বলো এসবের আর কোন মানে আছে!

“স্বপ্ন ” থেকে বাজার করে ঘরে ফিরছি। রিকশা ভর্তি বাজার।
দুপাশে বিবর্ণ, বিপন্ন মুখের সারি। সকলে ক্ষুধার্ত মুখে চেয়ে আছে। লজ্জাও লাগছে! ভয়ও! যেভাবে লোকজন চেয়ে আছে।
যাক সহি সালামতে বাসার সামনে নামা গেলো।
আন্টি ! আন্টি!
বলে গতিরোধ করে দাঁড়ালো একটি কিশোরী।
আমি বললাম কি চাই?
আন্টি! আমারে চিনতে পাইছেন! আমি আপনাগো বিল্ডিং এর নীচের বস্তিতে থাকি। একদিন যে আপনি আপনার মাইয়ার পুরান খেলনাগুলান তিনতলা থেইকা ফিইকা মাইরা মাইরা আমারে দিছিলেন। আর বস্তির ব্যাক পিচ্চিপাচ্চা হেগুলো নিয়া হাঙ্গামা শুরু করে দিছিলো!
আমি বললাম মনে আছে।
– আন্টি এই ঘুঘু জোড়া আপনারে কিনতে হইবো।
– কেন! আমি ঘুঘু কিনবো কেন?
– বাজারে এগুলোর দাম আটশো টেহা। আপনি খাঁচাশুদ্ধা পাশশ দিয়েন।
আমি হেসেই বলি আমার জন্য অর্ধেক কেন?
সে বলে আপনে এগুলো কিনলে আমি নীচ থিকে দেখবার পারুম।
আমি বলি না না আমি ঘুঘু নিবো না। এই নে একশো টাকা।
– না আন্টি ! আমি টাকা নিয়া কি করুম! এই টাকায় কদ্দিন চলবো ঘুঘুগুলার। আগে আমার বাপে রিকশা চালাতো। অহন রিকশা চালান বন্ধ। লকডাউন দিছেনা। আমরাই তো ঠিকমতো খাইতে পাইনা। কুনদিন পাইলে খাই। না পাইলে রোজা রাখি। আর এগুলান তো অবুঝ পাখি। খাওন না দিলে চিল্লাইতে থাকে। খুব মায়া লাগে। বাপে এহন আমগো লাইগা খাবার আনবো না ঘুঘুর লাইগা! আন্টি ! এগুলো নেন। আপনার মাইয়া খুশি হইবো। হ! আন্টি ! আমি দেখছি! আপনার মাইয়ার ঘুঘুগুলা খুব পছন্দ। ঘুঘুগুলা যহন ঘুঘুউ কইয়া ডাকে তহন খুব আরাম লাগে। আপনার মাইয়াই তো আপনার কাছে পাঠাইলো। সেই কহন থেইকা আপনার জন্য বইসা রইছি।

কি করবো বুঝতে না পেরে সিকিউরিটিকে বললাম বাজার আর ঘুঘুগুলো নিয়ে উপরে আসতে। আর মেয়েটাকে বললাম -ঠিকাছে তুমি দাঁড়াও আমি টাকা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
দাঁড়ান! দাঁড়ান! বলে একটা পলিথিনে মুড়ানো খাবার বের করে কিছু পরামর্শও দ্যায় মেয়েটি। তারপর খাঁচার বাইরে থাকা ঠোঁটগুলো নেড়ে নেড়ে কি যেন বলতে থাকলো।
কুকুরগুলোর চিল্লাচিল্লি শুনে জানালা খুলে দেখি মশক নিধন করতে আসা লোকটা স্প্রে নিয়ে ভাগছে, কুকুরগুলো পেছনে পেছনে দৌড়াচ্ছে লোকটার। হঠাৎ চোখ আটকে যায়!
আমাদের পাশের বিল্ডিং থেকে লাশ বের করা হচ্ছে। নীচে একটা এম্বুলেন্স আর সাদা পোশাক পড়া তিনচারজন মানুষ দেখে আমি পর্দা টেনে দিয়ে আবার লুডু খেলতে বসলাম বাপ-বেটির সঙ্গে। মেয়েটা আমার একটা প্রায় পৌঁছে যাওয়া ঘুটি কাটতে পেরে “ইয়ে! ইয়ে!” বলে উছলে উঠলো।
মঈন বলল – কি হয়েছে? আমি স্বাভাবিক ভাবে বললাম – না। কিছুনা।
তাহলে নীচে এতো শোরগোল কিসের? মঈন জিজ্ঞেস করল।
আমি বললাম – চাল নিয়ে গ্যাঞ্জাম মনে হয়।
বস্তির মেয়েটি মিথ্যে বলেনি। সারা দিন-রাত মেয়েটা ঘুঘুজোড়া নিয়ে পড়ে আছে। খাবার দিচ্ছে, পানি দিচ্ছে। একা একা গল্পও করছে। ঘুঘুটা ডাকলে সত্যি সত্যি মন আনচান হয়ে যাচ্ছে। মনে হয় গ্রামে আছি। চারদিকে গাছগাছালির সবুজ বেষ্টনী। বইগুলো বুকে চেপে খাঁখাঁ দুপুর। মুখে একটা কাঁচামিঠা আম। পড়নে স্কুলের আকাশীরং ড্রেস। পা দুটি ধূলায় ধূসরিত। মাঠের পর মাঠ ধানের শীষ দোল খাচ্ছে। প্রাইমারি স্কুলটার পেছনে প্রকান্ড আমগাছটিতে অনেক ঘুঘু। মুখরিত করে ডেকেই চলেছে- ঘুঘু ঘু… ঘুঘু ঘু…
ঘরের ভেতর সারাদিন গল্প করি। খুনসুটি করি। ফুপুবাড়ির গল্প, চাচার বাড়ির গল্প, তেঁতুলপাড়ার গল্প, আম পাড়াতে সুখ- এর গল্প, নদীয়া শালিককে কথা শেখানোর গল্প, মক্তবে পড়ার গল্প, লাভলি আপার অভিমানের গল্প, নীল পাখির বাচ্চা পাড়তে গিয়ে মামাতো ভাই গোলাপের হাত ভেঙে ফেলার গল্প, ছোটবোনের অবাধ্য প্রেমের গল্প, গোলাপি আপার বিয়েটা মেনে না নেওয়ার গল্প, ছোটখালার পালিয়ে বিয়ে করার গল্প, আমাদের দুর্দিনের গল্প, দুলাভাইর দ্বিতীয় বিয়ের গল্প! প্রাসঙ্গিক অপ্রাসঙ্গিক নানারকম গল্প। ছোট্ট এই জীবনে কত গল্প। যেন গল্পের শেষ নেই। তবু শেষ হয়ে আসে গল্প। সব গল্পের শেষে তবু চলে আসে এই শালা করোনার গল্প।
অবশ্য দিনের শুরুটা আরম্ভ করেছিল মঈন। বাথরুম থেকে বের হতেই দেখি চুল গুলো এবথেবরো করো ছাটা! চক্ষু চড়কগাছ! দেখতে কেমন আদিম যুগের মানুষের মতো লাগছে। আমরা মা মেয়ে হাসবো না কাঁদবো! কিছুক্ষণ পর ডুগি ছাটা! আমাদের এবার বন্য হাসি! দরজা ঠাস করে বন্ধ করে দিয়ে, কিছুক্ষণ পর ডুগি ছাটা! হাসতে হাসতে আমাদের চোখে জল! এরপর বাংলা সিনেমার জাম্বুর মতো ন্যাড়া! আমরা এবার থামি। ও হাসতে ধরলে আমরা এবার একসাথে হো হো করে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে হাসতে থাকি।
কতদিন পর এমন হাসলাম আমরা! কতদিন পর! এরপর কাঁদতে থাকি।
কথা ছিলো ওজন কমাবো। কয়েকদিন জাহাঙ্গীর কবিরের ভিডিও দেখলাম। এরপর সেন্ট্রাল হাসপাতালে পু্ষ্টিবিদ তাসনিম আশিককেও দেখালাম। কথা ছিলো ওজনটা কমলে দ্বিতীয় বাচ্চা নিবো।
আর বাচ্চাকাচ্চা!
সব ভেস্তে গেলো কীভাবে হঠাৎ!
আজকাল কখনো কখনো অভিমান হয় সৃষ্টিকর্তার উপর। অনিশ্চিত আর রোগে – শোকে ভরা এই দুনিয়ায় কেন নতুন প্রজন্ম আনবে এই মনুষ্য জাতি!

একটা কালো বিড়াল পাশের নির্মীয়মাণ বিল্ডিংয়ে বসে অদ্ভুতভাবে ডেকেই চলেছে। এই বিড়ালটাতো কখনো দেখিনি। কোথা থেকে এলো?
পুরো বিল্ডিংজুড়ে সেই বিড়ালটার ডাক মনে হয় গ্রাস করে ফেলেছে। টর্চ মারতেই বিড়ালটার চোখাচোখি হয়ে গেলো। বিড়ালটা কাঁদছে! দুচোখ বেয়ে মনে হলো কান্নাটা রেখাপাত হয়েছে। “বিল! বিল! ” করতেই বিড়ালটা আড়ালে চলে গেলো। আবার কিছুক্ষণ পর অদ্ভুত কান্নার আওয়াজ। সিকিউরিটিকে বললে সে কয়েকটা ঢিল মারে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার অবিরলভাবে কাঁদতে থাকে বিড়ালটি। জানালা টেনে দিলেও বেহুলা লখিন্দরের মতো কোন ফাঁক দিয়ে সে-ই কান্নার আওয়াজ আমাদের বিপন্ন করে তোলে। এই কান্না না শোনার জন্য আমরা পরস্পর জোর গলায় আলাপ করি। অযথা চেচামেচি করি। বিনা কারণে উচ্চস্বরে হাসতে থাকি। মাঝে মাঝে বিড়ালটার উদ্দেশ্য ঢিল ছুড়ি। ঢিলটাও কখনো কখনো যেন গভীর গহ্বরে তলিয়ে যায় কোন প্রতিধ্বনি না তুলেই।
ভাত হয়ে গেলে বাপ-বেটিকে ডাইনিং এ বসতে বলে জিজ্ঞেস করি আলুভর্তা আর টমেটোর ঘোন্টো আছে, তরকারি তো আর কিছু নাই। ডিম ভাঁজবো?
– হুম ভাঁজো।
-দুইটা না তিনটা?
দুটোই ভাঁজো। আমরা একটা ভাগ করে খাই কি বলো? কত মানুষই তো না খেয়ে আছে।
আমি আর কথা বাড়াই না।
তারপর খেতে খেতে জিজ্ঞেস করি, নিষেধ করার পরেও তো বাইরে গেলা! অবস্থা কি বাহিরের?
হাউজিং এর গেটটাই তো বন্ধ। গাড়িতো বের করতে পারলামনা। তারপর হাঁটলাম বড় রাস্তাটায়। মনে হলো কি লাগাই এক দৌড়! কিন্তু শরীরটা বেশ ভারীই মনে হলো, মনে হয় আর টানতে পারছিনা। একটা রিক্সা ডেকে উঠে পড়লাম। মনে হলো শহরটা মরে গেছে। যেন আদ কিংবা সামুদ জাতির মতো বিস্মৃত হয়ে গেছে সব। পৃথিবীতে কত সভ্যতাই তো বিলীন হয়ে গেছে। মহেঞ্জোদারো, ব্যাবিলন,ইনকা, মায়া কতো সভ্যতাই তো নাই হয়ে গেছে। হয়তো আরো অনেক সভ্যতা ছিলো, যার খোঁজ আমরা কোনদিনও পাবোনা। আর এখন লক্ষ্মণ ছাড়াই কুপোকাত!
আহ! থামোতো। কীসব আজেবাজে বকছো! মেয়েটার সামনে। কোন ঔষধ কিংবা ভ্যাকসিন নিশ্চয়ই আবিস্কার হয়ে যেতে পারে। আর সামনে রমজানও আসছে। আল্লাহর রহমতে আমরা গ্রামেই ঈদ করবো ” সেই সে ঈদগাহে”! তুমি দেখে নিয়ো। বলে থামাই ওকে।
– ঔষধ আসতে পারে আবার নাওতো আসতে পারে, ততদিনে আমরাও ফুস! আর রমজানের কথা বলছো! খবর শুনে আসলাম! আজকেও বিএসএফ শিমোন রায় নামে একটা স্টুডেন্টের পেটে গুলি করেছে, তাও বাংলাদেশে ঢুকে! ভারতে মুসলিমদের উপর টার্গেট করছে, ইসরায়েল ফিলিস্তিনের একটা হাসপাতাল গুড়িয়ে দিছে। সৌদী বাচ্চারা ইয়েমেনের উপর হামলা চালিয়েছে আর আমাদের দেশে? ত্রাণচোরদের কথা আর নকল মাস্কের কথা বাদই দিলাম। ওগুলো রাষ্ট্রের বিষয় কিন্তু করোনার অভিযোগে শিক্ষিত ছেলেমেয়ে জন্মদায়িনী মা’কে রাস্তায় রেখে পালিয়েছে। গোরস্থানে দাফন করতে দিবেনা বলে ব্যানার টাঙিয়েছে, লাশ বহনের জন্য খাটিয়া দিচ্ছেনা মসজিদ কমিটি আর তুমি রহমত আশা করছো! আমার তো মনে হয় নূহ নবীর আমলের মতো এই গোলোকায়িত জাতির অবসান দরকার!
তুমি থামবে? চেচিয়ে উঠে মঈনকে থামাই।
ততক্ষণে ওর নাকেমুখে উঠে কাশতে থাকে। কাশতেই থাকে। ওর কাশার ধরন দেখে দুজনে চোখ চাওয়াচাওয়ি করি। ভয় পেয়ে মেয়েটার দিকে তাকাই। মেয়েটাও ভয় পেয়ে যায়। ওর বাবাকে পানি এগিয়ে দেয়।
তারপর রেগে গিয়ে বলি তোমাকে না বাইরে বের হতে নিষেধ করেছিলাম!
মনকে প্রবোধ দেই বিষমই হয়তো বা। বিষমই যেন হয় মাবুদ!
এরপর ম্যাগাজিন পড়ে, বইপত্র উল্টিয়ে, করীম দুলাভাইর মৃত্যু নিয়ে, পুরনো এলবামে ছবি দেখে, কোরআন তেলোয়াত করে, আরো বাজার করে রাখার প্ল্যান বিশেষ করে ডাল, ছোলা,মুড়ি, ব্যাসন, পেঁয়াজ, তেল, মাছ বেশি করে কিনে রমজান মাস অতিক্রম আর ঈদে কাউকেই কোন কাপড়চোপড় না কেনার সিদ্ধান্ত নিয়ে কখন যেন রাত চারটা বেজে যায়।
ঘুমন্ত মেয়েটার কপালে একটা মশা রক্ত চুষে টইটম্বুর হয়ে আছে। আস্তে করে টিপ দিতেই কী সহজেই তর্জনী আঙুলে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলো রক্তচোষাটি। অথচ কিছুক্ষণ আগেই কোনভাবেই মারা যাচ্ছিলোনা। ও কি তখন ভেবেছিলো এই রক্তের ভারই তার মৃত্যুর কারণ হতে যাচ্ছে!
আর রাতজাগা ঠিক হচ্ছেনা দেখে বললাম
চলো শুয়ে পড়ি। আমি হাতমুখ ধুয়ে আসি ততক্ষণে তুমি বইপত্র গোছাও। ও ঠিকাছে বলে বিছানা থেকে উঠে।
বাথরুমে আয়নায় নিজেকে দেখি। আরো মোটা হয়ে যাচ্ছি মনে হয়। পাকা চুলগুলো কয়েকটা বের হয়ে গেছে। অফিস নেই তাই কালারও করা হয়না।
ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে দেখি ও তখনও একটা বই পড়ছে। কী এতো মনোযোগ দিয়ে পড়ছে? কাছে গিয়ে দেখি পাঞ্জেগানা কিতাব! জানাযার নামাজের নিয়্যত মুখস্ত করছে।
আজান হচ্ছে ফজরের। ঝড়ও উঠেছে। বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে খুব। বেলকনি থেকে কাপড়চোপড়গুলো ঘরে আনলাম। ঘুঘুগুলোও ঘরে এনে রাখলাম। মেয়েটাও উঠে গেছে। রেইন হচ্ছে! বলে হাত দুটো জানালার বাইরে প্রসারিত করে দিলো।
আজান হয়েই যাচ্ছে। কাছাকাছি এতগুলো মসজিদ! আর এতো আজান কই কখনো শুনিনি তো! আজানটা আজ যেন অন্যরকম লাগছে। তুমুল বৃষ্টি, চমকানো বিজলি , আজানের সুর আর আর আমরা তিনজন মানুষ !
বৃষ্টি থামে। নিয়ম করে ভোর হয়। মেয়েটা ঘুঘু দুটোকে খাবার দেয়। টবের গাছগুলোতে পানি ঢালে। এরপর একটা করে ড্রাইকেক গলাধঃকরণ করি।
হঠাৎ মেয়ে বলে – মা! ছাদ খোলা আছে?
আছে তো! কেনরে?
ছাদে যাবো।
এতো কেন কেন করোনাতো! যেতে ইচ্ছে করছে! অনেক বোরিং লাগছে।
মঈন বলে যাওনা! এতো করে বলছে!
যাও মানে? আমি একা যাবো নাকি?
বলেই মা-মেয়ে মিলে টেনে বিছানা থেকে নামাই।
মেয়েটা ঘুঘুজোড়াও সঙ্গে নেয়। সিঁড়ি বেয়ে হিমালয় জয় করার ফিলিংস নিয়ে ছাদে বসে আছি। তখনো পৃথিবী অন্ধকার। নারীকেল গাছটার পাতাগুলো শিহরণ তুলছে। দূরে একা দাড়িয়ে আছে একটা মসজিদের মিনার। আমগাছটার মগডালে কালকের ঘুড়িটা এখনো দুলছে। মুখ থুবড়ে পড়ে আছে চেনা শহর। গভীর ঘুমে নিমজ্জিত। কে যেন জাদুস্পর্শে অচল করে রেখেছে এই শহরের গাড়িঘোড়া, লঞ্চ-স্টিমার, ট্রেন, উড়োজাহাজ, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, বাজারের কোলাহল, স্কুলের ঘন্টাধ্বনি আর চা, ফুচকা চটপটির দোকানগুলো।
মেয়েটা ওর আব্বুর হাতে একটি ঘুঘু ধরিয়ে দিয়ে ও নিজেও আরেকটা খাঁচা থেকে বের করে বলে – আম্মু সারাদিনরাত ঘরে থেকে থেকে কেন জানি ঘুঘু দুটোর জন্য খুব কষ্ট হলো। এক কাজ করি- ঘুঘুদুটো ছেড়ে দেই৷ তোমরা দুজনে মিলে একটা আর আমি একটা। ঠিক আছে?
আমরা ওর কথা শুনে তাজ্জব বনে যাই। এরপর ঘুঘুদুটো মুক্ত করে দেই। পতপত শব্দ করে দুজনেই উড়ে যাচ্ছে। উড়েই যাচ্ছে। আকাশ বেয়ে বেয়ে উড়েই চলে যাচ্ছে। উড়তে উড়তে মিশে গেলো পুবাকাশে। যেখান থেকে উদিত হচ্ছে নতুন আলোর রেখা !

করোনাকাল || নয়ন তানবীরুল বারী

Facebook Comments