দান
গেলো তিন দিন পেটে ভাত পড়েনি হাসুর বউ পোলাপানের। তিনখান ছাওয়াল আর আর বউটা শুকায়ে পানিশাল কাঠের মতো কালো হয়ে গেছে। হাসুর সুন্দরী বৌয়ের মুখ ঢাকার মতো আচলটাও নাই। হাসু মতি বিড়ির ধোঁয়া খেয়ে কয়দিন ভালই চলছিল এখন ক্ষিধের ঠেলায় হাত পা কাহিল হয়ে পড়েছে। কাজ নাই কাম নাই চারদিকে হাহাকার। পুবালি বাতাসে এখন চারপাশে আকালের গন্ধ ভাসে। মজুরদের পকেটে আজ টাকা নেই, ঘরে চালও নেই, আছে একপাল বৌ পোলাপান, খাবার মতো অনেকগুলো মুখ। কলের পানি আর কচুর লতা খেয়ে কোন মতে তাদের জানটা বেঁচে আছে এখনো। ক্ষুধার্থ শকুনের মতো চোখগুলোতে দুমুঠো ভাতের দাবি।…
হঠাৎ ভদ্রপাড়ার এক সাহেব সাই সাই করে গাড়ি ছুটে এলেন ভুখা গাঁয়ের হাসুর ভিটায়। পিছে পিছে ছোট বড় ক্যামেরা নিয়ে ডজন খানেক সাংবাদিক। গাড়ির সামনে টানানো ব্যানারে বড় করে লেখা গরিবের মাঝে ত্রাণ বিতরণ। গাড়ি থেকে কালো কোর্ট পড়া সাহেব নেমেই বলতে লাগলেন এই বাড়ি কার সামনে আসেন। হাসু দৌড়ে গিয়ে লম্বা সালাম দিলো। জিজ্ঞেস করলেন পরিবারের সদস্য কতজন? আল্লাহর মাল ৩ পোলাপানসহ পাঁচ জন..হাসু উত্তর দেয়।
ত্রাণ দিবো, সবাইরে নিয়ে আসো।
বলতে না বলতেই সবাই হাজির। ত্রাণের ব্যাগটা দেখে হাসুর ছেলেমেয়ের ভোকটা যেন বেড়ে গেলো। বড় বড় চোখ আর জিভের ডগায় কয়েক ফোটা জল টলটল করছে।
দুই কেজি মোটা চাল আর কয়টা আলু ভর্তি একটা ব্যাগ হাতে নিলেন সাহেব। তুলে দিলেন হাসুর হাতে। না কেবল হাসু না হাসুর পরিবারের পাঁচজনেরই হাতে। ইশারা দিতেই সাংবাদিকরা ফটাফট ছবি তুলতে লাগলেন। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ বসে আবার কেউ বাঁকা হয়ে তুলছে ছবি।…….না ছবি ভাল হচ্ছে না। হাসুর মুখটা বেজার। সবাই হাসুকে একটু হাসিমুখে ক্যামেরার দিকে দেখতে বললেন। নাম হাসু হলেও আকালে পড়ে হাসিটাই ভুলে গিয়েছিল সে। পিড়াপিড়িতে এবার দাঁড় ক’খানা বের করলো জোর করে। অনেকগুলোর ক্যামেরার ফ্লাশ লাইন ঝলকে উঠলো। পরদিন পত্রিকাতে জনদরদি সেই নেতার গরিবের পাশে দাঁড়ানোর লম্বা কাহিনী ছাপানো হলো। সঙ্গে হাসুর ছবিটিও বড় করে দেয়া হয়েছে। খবর পড়ে অনেকে সেই নেতাকে বাহবা দিলো। ছবিটায় হাসুর গরিব চেহেরা উজ্জল মর্যাদা পেয়েছে। ক্যামরাম্যানের হাত ভাল বলতেই হয়। পত্রিকায় নিজের হাসিটা দেখে নিজেও খানিক চমকে উঠে হাসু। এমন করে কোন দিন সে হাসেনি। মনে মনে ভাবে হাসু যাক ছবি তুলেছে তুলুক গরিবের সারিন্দার মতো পেটে কয়টা ভাত ঢুকেছে তো।
দান || মো. লুৎফর রহমান