ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা-ভাবনা

0
2400

ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হওয়ার চিন্তা-ভাবনা

উদ্যোক্তার জন্ম হয়, নাকি উদ্যোক্তা তৈরী হয় এই নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, সেটা নিয়ে পরে বিতর্ক করা যাবে । আপাততঃ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হওয়া নিয়ে লেখাটা শুরু করি । উদ্যোক্তা হওয়ার কতগুলি সুবিধা আছে। যেমন-নিজের স্বাধীনতাঃ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা নিজেরাই নিজেদের বস। তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারে । তারা নিজেরাই পছন্দ করতে পারে কার সাথে ব্যবসা করবে এবং তারা তাদের সাথে কি কাজ করবে। তারা সিদ্ধান্ত নিতে পারে কত ঘণ্টা তারা কাজ করবে, সাথে সাথে কত টাকা তারা নিবে এবং কখন তারা ছুটি নিবে। গন্তব্যে পৌঁছানোর জন্য তারা কতটুকু ঝুঁকি তারা নিবে।

টাকা-পয়সা অর্জনঃ কোন জায়গায় কাজ করে টাকা পয়সা আয় করার চেয়ে, এখানে অনেক বেশী সম্ভবনা আছে অধিক রোজগার করার। একজন চাকুরীজীবি হিসেবে সীমিত আয়ের ব্যাপারটা এখানে থাকে না। অনেক নতুন নতুন স্টার্টআপ বা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বড় বড় মেগা-মিলিওনারদের দেখে উৎসাহিত হয়। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়-ষ্টিভ জবস- পুরো নাম ষ্টিভেন পাউল জবস, তিনি আ্যাপল ইনকর্পোরেশনের চেয়ারম্যান, কো-ফাউন্ডার ও চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার। তাঁর বিখ্যাত উক্তি-“ I want to put a ding in the universe”.“ Design is not just what it looks like and feels like. Design is how it works”. “ Innovation distinguishes between a leader and a follower.” এলন মাস্ক- পুরো নাম এলন রিভি মাস্ক,তিনি একজন প্রযুক্তি বিষক উদ্যোক্তা ,তিনি স্পেস এক্স-এর প্রতিষ্ঠাতা,সিইও এবং লিড ডিজাইনর। স্পেসএক্স হলো, আমেরিকান প্রাইভেট এরোস্পেস ম্যানুফ্যাকরার ,জেফ বেযোস- পুরো নাম জেফরে প্রেষ্টন বেযোস, তিনিও একজন প্রযুক্তি বিষক উদ্যোক্তা ,তিনি আমাজান ডট কম ইনকর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠাতা,সিইও এবং চেয়ারম্যান, তাঁর তিন উক্তি-“If you do build a great experience, customers tell each other about that.” “Word of mouth is very powerful.” “A brand for a company is like a reputation for a person. You earn reputation by trying to do hard things well.” “There are two kinds of companies, those that work to try to charge more and those that work to charge less. We will be the second. ” মার্ক জুকারবার্গ- পুরো নাম মার্ক ইলিওট জুকারবার্গ, তিনিও একজন প্রযুক্তি বিষক উদ্যোক্তা, তিনি ফেস বুকের সিইও এবং চেয়ারম্যান। বিল গেটস – পুরো নাম উইলিয়াম হেনরী গেটস, তিনি মাইক্রোসফট কর্পোরেশনের প্রিন্সিপ্যাল প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর বিখ্যাত উক্তি-“ Your most unhappy customers are your greatest source of learning.” “Life is not fair; get used to it”.লেরী পেজ- পুরো নাম লোওরেন্স এডয়্যার্ড পেজ- তিনি একজন আমেরিকান কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও ইন্টারনেটের উদ্যোক্তা। তিনি ও সারগেই ব্রিন গুগলে কো-ফাউন্ডেড করেন এবং আলফাবেট ইনকর্পোরেশনের সিইও। রিচার্ড ব্রানসন-স্যার রিচার্ড চার্লস ব্রানসন, তিনি একজন ব্রিটিশ বিজনেস ম্যাগনেট, তিনি ভার্জিন গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর তিনটি বিখ্যাত উক্তি –“You don’t learn to walk by following rules. You learn by doing, and by falling over.” “Business opportunities are like buses, there’s always another one coming.” “Do not be embarrassed by your failures, learn from them and start again.” ওয়ারেন্ট বাফেট- পুরো নাম, ওয়ারেন্ট এডয়্যার্ড বাফেট, তিনি একজন আমেরিকান বিজনেস ম্যাগনেট। তিনি বার্কসায়ার হাথায়য়ের চেয়ারম্যান ও সিইও । তাঁর উক্তি- “Price is what you pay. Value is what you get.”
কনট্রোলঃ এখানে একজন বা একটি গ্রুপকে সমস্ত বিজনেসটিকে চালিয়ে নিতে হয়, কনসেপ্ট থেকে ডিজাইন, ডিজাইন থেকে নতুন কিছু করা, সেলস, অপারেশনস এবং কাস্টমার রেসপন্স সবই নিজেকে করতে হয়। এখানে কাজ যারা পাগল এবং নূতন কিছু করার ক্ষুধা যাদের আছে তারা নিজের মত করে একটি ভিশন তৈরী করে, সেটা অর্জন করার জন্য একটি লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া যায় । এখানে নিজেকে আত্ম-উৎসকারী ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা সমাজে নতুন কিছু করতে পারে।

আত্মসম্মানঃ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের মানুষ সম্মান করে। নিজে কিছু করার মধ্যে আত্মতুষ্টিও থাকে। কেউ যখন জিজ্ঞাসা করে, কে এইটি করেছে, তখন উদ্যোক্তারা বলতে পারে আমি এইটি করেছি বা এইটি আমার বা আমাদের।
সততাঃ এখানে সততা, স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিয়ে চলার সুযোগ থাকে । বিজনেস দাঁড়িয়ে গেলে,পরবর্তী জেনারেশন অর্থাৎ ছেলে –মেয়ে দাঁড়ানোর একটি প্লাটফর্ম তৈরী হয়।

সুযোগঃ ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা কিছু মানুষের চাকুরীর সুযোগ তৈরী করতে অবদান রাখতে পারে এবং স্থানীয় অর্থনৈতিতেও সাহায্য করতে পারে। সুবিধার পাশাপাশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কিছু অসুবিধা আছে।একটি ছোট বালক যখন, রোলার-কোষ্টারে উঠে, তখন সে শুধু উপরে উঠতে চায়, ভয়ে নিচে নামতে চায় না । ক্ষুদ্র বিজনেসের বেলায়ও অনেক কিছু অসুবিধা আছে ।

সময়ের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করাঃ যখন কেউ একটা নতুন বিজনেস শুরু করে, বিশেষ করে একদম শুরুর দিকে, যখন তাদের খুব কম এমপ্লয়ি থাকে, এ সময় সকল প্রকার কাজ ও দায়িত্ব উদ্যোক্তাকে নিজে পালন করতে হয় । এই সময় একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাকে ১২-১৪ ঘণ্টা প্রতি নিয়ত কাজ করতে হয়। প্রতিটি কাজ শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যেমন- কেনা থেকে ব্যাংকিং ও প্রচারণা পর্যন্ত। এই সময় পরিবারের উপর একটা চাপ পরে এবং বন্ধু ও শুভাকাংখিদের সাথে সময় দেয়া ও কথা রাখা কঠিন হয়ে পরে।

রিস্কঃ বিজনেস গোছানো হলে রিস্ক ও দায়দেনা কিছুটা কমে, কিন্তু রিস্ক কখনো একেবারে দূর করা সম্ভব না । সফল উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে যখন কেউ সিকিউর্ড চাকুরী ছেড়ে দেয় এবং কোন কারণে যদি বিজনেস ভালো না হয় অথবা ব্যর্থ হয় তাহলে ফাইন্যান্সিয়ালি বড় ধরণের ধাক্কা খেতে হয়, যেটা ম্যানেজ করা খুব কঠিন হয়ে পড়ে। ফাইন্যান্সিয়াল রিস্ক ছাড়াও উদ্যোক্তাদের আরো অনেক রিস্ক এর কথা চিন্তার কথা মাথায় রাখতে হয়, যেমন-প্রোডাক্ট, এমপ্লয়ির অসহযোগিতা এবং রেগুলেটরির যাবতীয় প্রয়োজনীয়তা পূরণ করা ইত্যাদি ।

অনিশ্চয়তাঃ কোন কোন সময় শুরুতেই ব্যবসা সফল হতে শুরু করে কিন্তু অন্যান্য ফ্যাক্টর যেমন- অর্থনৈতিক মন্দা, নতুন নতুন প্রতিযোগী বাজারে আসা অথবা ক্রেতার চাহিদা পরিবর্তন হয়ে যাওয়ার কারণে ব্যবসার গ্রোথ কমে যেতে পারে বা অনেক সময় থেমে যায়। এছাড়াও কিছু কিছু অনিশ্চয়তা আছে যেমন- সামাজিক কারণ সমূহঃ ডেমোগ্রাফিক ট্রেন্ড, কালচার, লাইফস্টাইল , ডায়েট ও ফ্যাশান সচেতনার পরিবর্তন। প্রযুক্তিগত কারণ সমূহঃ নতুন প্রযুক্তি,বিকল্প জিনিষের ব্যবহার এবং নতুন নতুন সিস্টেম । পরিবেশগত কারণ সমূহঃ আবহাওয়া ও জলবায়ুর পরিবর্তন, নতুন নতুন রোগ, পোকা মাকড় ও রোগের প্রাদুর্ভাব প্রকোপ হওয়া ।

অর্থনৈতিক কারণ সমূহঃ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিষ পত্রের দাম বাড়া বা কমা, মৌসুমের ভিন্নতা, মানুষের ক্রয় ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা। রাজনৈতিক কারণ সমূহঃ রাষ্ট্রের নতুন নতুন আইনকানুন, বিভিন্ন ধরণের ট্যারিফ ও গাইড লাইন ইত্যাদি আরোপিত হওয়া।

ফিনান্সিয়াল প্রতিশ্রুতিঃ ব্যবসা যতই ছোট হোক না কেন মূলধন লাগবেই। অনেক মানুষ তার ছোট ব্যবসাটি শুরু করেন, ব্যক্তিগত সঞ্চয়, ডিপিএস ভেঙে অথবা অবসরকালীন পাওয়া টাকা দিয়ে । এইভাবে ব্যবসা শুরু করলে অনেক সময় ব্যক্তিগত ও পারিবারিক চাহিদা পূরণে কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়। বেশীর ভাগ সময় নতুন উদ্যোক্তা তার ফান্ড সংগ্রহ করে নিজের বাড়ি ও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ব্যাংকে মর্টগেজ রেখে। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে ব্যাংক, ফিনান্সিয়াল লিজিং কোম্পানী গুলো বড় ধরণের ফিনান্সিয়াল ব্যাকআপ না থাকলে বা ফিনান্সিয়াল প্রতিশ্রুতি না দিতে পারলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের কোন ধরণের ঋণ দিতে চায় না । ফলে এলসি, ভেন্ডর প্যামেণ্ট,এমপ্লয়ির বেতন ও বিজনেসে গ্রোথ আনা অনেক সময় কঠিন হয়ে পরে। এত অনিশ্চয়তার পরও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ব্যবসা শুরু করার ব্যাপারে খুশি । Wall Street Journal and Cicco and Associates Inc. কর্তৃক পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা ও টপ লেভেলের কর্পোরেট এক্সিকিউটিভরা ভীষণভাবে স্বীকার করেন যে, তুলনামূলকভাবে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা তাদের কাজের বেপারে অনেক বেশী সন্তুষ্ট , টপ লেভেলের কর্পোরেট এক্সিকিউটিভদের তুলনায়। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা ছোট ব্যবসা শুরু করার আগে, আগে আপনাকে দেখতে হবে কোন বিষয়ে আপনি ভালো জানেন এবং ঐ বিষয়ে বর্তমানে কী কী সমস্যা আপনার চোখে পড়ছে, সেই সমস্যাগুলোর সমাধান করার বিষয়টিও আপনার ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করার আইডিয়া হতে পারে। তার পর লক্ষ্য ঠিক করতে হবে। এরপর আপনার ব্যবসার সম্ভাব্য গ্রাহক কারা, তাদের সমন্ধে জানা। আপনার এই আইডিয়াটি কোন বিনিয়োককারীকে যদি ৩০ সেকেন্ডে বুঝাতে পারেন, তাহলে আপনার ব্যবসাটি সফল হওয়ার সম্ভাবনা আছে। এর পর দরকার নিজের সব জ্ঞান, ধ্যান-ধারণা ও সময়ের সৎ ব্যবহার, যাতে আপনি আপনার গ্রাহকের ভাষা বুঝতে পারেন এবং গ্রাহকের ভাষা অনুযায়ী, প্রোডাক্ট তৈরী করতে পারেন। এর পর প্রতিযোগিতার পথে নেমে পরা, পথে নামলেই কেবল পথ চেনা যায়। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন- “লক্ষ্য ঠিক রেখে সামনের দিকে দৌড়াতে থাকো, প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় হয়তো হতে পারবে না কিন্তু লক্ষ্য ঠিক রেখে দৌড়াতে থাকলে, এক সময় না সময় তোমার গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে পারবে” ।

তাই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন থাকলে, প্রথমে বুঝুন-শুনুন , পথে নেমে পড়ুন এবং দৌঁড়াতে থাকুন।

লেখক :

কৃষিবিদ মো: আববাস আলী 

পরিচালকঃ সেলস এন্ড মার্কেটিং, ম্যানেজিং পার্টনার  এক্সপ্লোর বিজনেস লিমিটেড

Facebook Comments