ঢাকাস্থ মায়েদের দৈনন্দিন অস্থিরতা

0
1910

ঢাকাস্থ মায়েদের দৈনন্দিন অস্থিরতা

নানা কারণে ঢাকাস্থ মায়েদের দৈনন্দিন অস্থিরতা বাড়ছে যেমন-

ডেঙ্গু : রাজধানীতে ডেঙ্গু আশঙ্কাজনক বাড়ার কারণে সকল মায়েদের ডেঙ্গুর ভাইরাসজনিত রোগ থেকে পরিবারের সকল সদস্যদের রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছে। সকাল-বিকাল মশার ঔষধ ষ্প্রে করা, সকালে ও বিকালে নিয়মিতভাবে এমনকি দিনের বেলাতেও মশারি ব্যবহার করা। সমস্ত ঘর-বাড়ি পরিষ্কার রাখা, কোথাও কোন পানি জমে থাকলে তা তন্নতন্ন খোঁজা ও পরিষ্কার করা অর্থাৎ বাড়ির সমস্ত সম্ভাব্য এডিস মশার প্রজনন উৎসকে ধ্বংস করা। সকল সময় মায়েদের চিন্তা বাসা নাহয় পরিষ্কার রাখলাম কিন্তু স্কুলে অথবা কোচিং সেন্টারে যদি মশা কামড়ায় তাহলে কিভাবে সন্তানদের ডেঙ্গু ঠেকাবো। জ্বর আসলেই অজানা আশংকায় ভুগা, এই বুঝি এনএস ওয়ান পজিটিভ হল অর্থাৎ ডেঙ্গু ধরা পরলো। টিভি খুলেই ডেঙ্গু জনিত কারণে নানা জনের নানা খারাপ খবর শোনা, বাসায়, লিফটে, নীচে হাটতে গেলে, স্কুলে সকল জায়গায় সকল ভাবীরা একই কথা ডেঙ্গু ডেঙ্গু। কীহবে আল্লাহ এবছর কি বিপদ দিলো,কী পাপ করেছি আমরা। এছাড়াও নানা ধরণের লোসন, মশা মারার বেড, নারিকেল তেল, ফুলহাতা শার্ট সংগ্রহ করা, সন্তান ছাড়াও পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা লোসন মাখলো কিনা, মশারি লাগালো কিনা, দরজা জানালা বন্ধ আছে কিনা, এই সব বিষয় নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকা। এবছর ভাইরাসটির সেরোটাইপ পরিবর্তিত হওয়ায় র‌্যাশ, বমি, প্যাটের ব্যথা, নিউমোনিয়া,চোখ লাল হওয়া ছাড়াও, বাচ্চারা পায়খানা করলে সেটাও লক্ষ্য রাখা, পায়খানায় রক্ত যায় কিনা; কারণ এবছর এই লক্ষণটি নতুন ভাবে দেখা যাচ্ছে বলে, পেপার পত্রিকায় দেখা যাচ্ছে। এমনকি শোয়ার সময় মশারির ভিতর মশাটি না মারা পর্যন্ত মায়েদের অস্থিরতা কাটেনা। তাছাড়া স্কুলে কোন ছেলের প্ল্যাটিলেট কত কমলো, হাসপাতাল ও প্রাইভেট ক্লিনিগুলেতেও নাকি জায়গা নাই, এই ধরণের নানা চিন্তায় মায়েদের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছে। সড়ক দুর্ঘটনা: সড়ক দুর্ঘটনায় নিয়মিত প্রচুর ছেলে-মেয়ে নিহত হচ্ছে। যেমন আবরারের মৃত্যুর খবর সকল মায়েদের কাঁদাল, শেরেবাংলা নগরে ট্রাকের ধাক্কায় এক কলা বিক্রেতার মৃত্যু, মিরপুর এলাকায় মোটরসাইকেলের ধাক্কায় এক ব্যক্তি মারা গেছেন। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় গতকাল দুটি পৃথক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনজন নিহত, গতকাল রাজধানীর জাহাঙ্গীর গেটের কাছে একটি বাস ও মোটরসাইকেলের চাপায় একাত্তর টিভির এক কর্মচারী নিহত। রাজধানীতে সড়ক দুর্ঘটনায় দু’জন নিহত ও একজন আহত হয়েছেন। আমার সন্তানেরা স্কুলে গেছে কখন যে তারা ফিরে আসবে, কোন দুর্ঘটনা ঘটবে কিনা, ওর বাবা এখনও ফিরে আসছে না কেন, কোন দুর্ঘটনা ঘটলো কিনা, এই ধরণের নানা চিন্তা মায়েদের অস্থির করে রাখে। ট্র্যাফিক জ্যাম: সন্তানদের স্কুলে নিয়ে যাওয়া ও আসার সময় ভয়াবহ ট্র্যাফিক জ্যাম নিত্যনৈমিত্তিক ব্যপার হয়ে দাঁড়িয়েছে যা মায়েদের ব্লাড প্রেসার বারার উপক্রম হওয়ার দশা। সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন, যাতে ঢাকার ভয়াবহ যানজট রোধে সরকারকে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠনের নির্দেশনা চেয়ে হাইকোর্টে আবেদন করা হয়। কিন্তু কে শোনে কার কোথা। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, উল্টা দিক থেকে গাড়ি চালানো একটি রোগ, যা বেশিরভাগ সময় প্রভাবশালীদের দ্বারা ঘটে যা যানজট সৃষ্টি করে।এই যানজটের কারণে প্রচুর ক্ষতি হয় এইটা আমরা সবাই জানি কিন্তু কী করার আছে আমাদের। এইতো সেইদিন, বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট জানায়, ঢাকার যানজট প্রতিদিন প্রায় ৫ মিলিয়ন বা ৫ লক্ষ কর্মঘণ্টা খায় এবং পিক আওয়ারের সময় যানবাহনের গড় গতি ৫ কিলোমিটার নেমে আসে। তাছাড়া বৃষ্টি, জলাবদ্ধতা ও রাস্তার সংস্কাররের কারণেও মাঝে মাঝে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়, যা প্রতিটি মাকে প্রতি মুহূর্তে অস্থির করে তুলে। কাজের বুয়াঃ ইদানিং কাজের বুয়া ধরে রাখা একটি দূরহ কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কোন কাজের বুয়াই ৩-৪ সপ্তাহের বেশী এক বাসায় কাজ করে না। ৩-৪ সপ্তাহের মধ্যে ১ সপ্তাহ তারা আসবে না কিন্তু কিছু বলাও যাবে না আবার বেতন কর্তনের কথা তো মায়েরা চিন্তাও করতে পারে না। উপরন্তু কিছু বুয়া মায়েদেরকে ধমকের সুরে কথা বলে কিন্তু মায়েরা অসহায়। কারণ প্রতিদিন ঘর মোছা, আসবাবপত্র পরিষ্কার করা,কাপড় ধোয়া,থালা বাসন ধোয়া,কাটাকাটি করা এবং রান্না করা। প্রতি কাজের জন্য মাসে ৭০০ টাকা করে হলে, ৫ কাজের জন্য প্রয়োজন ৩৫০০ টাকা আর রান্নার জন্য ৪০০০ টাকা অর্থাৎ সর্বোসাকুল্যে ৭৫০০ টাকা দেওয়ার পরেও তারা কাজে নিয়মিত আসেনা। মেহমান বাসায় আসার কথা শুনলে পরের দিন নিশ্চিত আসবে না এবং মোবাইল বন্ধ থাকবে এটা অবধারিত এবং ওই দিন সে অন্য বাসায় কাজের জন্য কথা বলবে এবং পারলে দুই একটা কাজও খুব ভালো ভাবে, করে দিয়ে আসবে অধিক বেতনের আসায়। বুয়াদের কাজ পাওয়ার প্রধান হাতিয়ার হল, বর্তমান যে বাসায় কাজ করে, সেই বাসার মায়েদের দুর্নাম করা এবং কিছু খারাপ মন্তব্য বা নির্যাতনের কথা বলা যাতে নতুন বাসার মায়ের মনে দয়ার উদ্রেক হয় এবং বেশী টাকা ও কাজটা পেতে সহজ হয়। বুয়াদের আরও নানা রকম জ্বালা আছে যেটা মায়েদের সহ্য করতে হয়। এত বেতন ও নানা রকম কিছু দেওয়ার পরও বড় বড় কাজগুলো মায়েদের করতে হয়। যেমন-ছেলে-মেয়েদের জন্ম দিনের রান্না, মেহমান বা আপন জন কেও আসলে তাদের রান্না, বিভিন্ন রকম ধর্মীয় অনুষ্ঠানে রান্না মায়েদের নিজে করা ছাড়া বিকল্প কিছু চিন্তা করার উপায় নাই। এছাড়াও যেহেতু বুয়ারা অঘটনঘটনপটিয়শী, ফলে মায়েদের মনে তাদের নিয়ে একটা বাড়তি অস্থিরতা সবসময় বিরাজ করে। প্রাইভেট ড্রাইভারঃ প্রাইভেট ড্রাইভার নিয়েও মায়েদের টেনশনের শেষ নাই। প্রতিটি মা সকাল বেলা ছেলে-মেয়েদের নিয়ে অসম্ভব ব্যস্ত থাকেন, তা আমরা সকলেই জানি।বিশেষ করে যদি প্লে থেকে কেজি টু পর্যন্ত স্কুল গোয়িং ছেলে-মেয়ে থাকে তাহলে তো কোন কথাই নাই। ঘুম থেকে উঠানো, ইউনিফর্ম পড়ানো, নাশতা খাওয়ানো এবং টিফিন রেডি করা এই নিয়ে যখন মায়েদের দম ফেলানোর সময় থাকেনা, তখনও ড্রাইভার আসার কোন খবর নাই, ওই সময় তাদের ফোনে পাওয়া অত্যন্ত কষ্টকর, ফোনে পেলেও আসতেছি, আসতেছি মানে তখনও সে রওনা দেইনি, আসার পর বলবে মোবাইলে চার্জ ছিল না, এলার্ম বাজেনি, গাড়ী স্টার্ট নিচ্ছে না, অথচ রাতের বেলায় গাড়ী ভালো ছিল। যদিওবা সবকিছুর পর রওনা হয় , তখন বলবে ম্যাডাম কোন দিক দিয়ে যাবো, এই দিক দিয়ে গেলে ট্রাফিক ক্যাস দেয়, ওই দিক দিয়ে গেলে প্রচুর জ্যাম, এমতাবস্থায় রাস্তায় যানজট ও স্কুলের দরজা বন্ধের কথা চিন্তা করে মায়েদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা। সকালে গাড়ী উঠার সময় তাকে মোবাইলে পাওয়ায় দুষ্কর, অথচ গাড়ী রাস্তায় উঠার পর পরেই মোবাইল বাজতেই বাজতেই থাকে। মাস শেষ হওয়ার আগে টাকা বার বার চাওয়ার কথা না হয় বাদেই দিলাম। কোন কারণে কোন আত্মীয়-স্বজনেকে অথবা কোন ছেলে-মেয়েদের বন্ধুকে কোথাও ড্রপ দেওয়ার কথা বললে তার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ে। ঈদ আসার আগে মায়েদের একটা মহাচিন্তায় পড়তে হয়, ঈদের পড়ে ড্রাইভার থাকবে না, এটা এক প্রকার নিশ্চিত কারণ বেতন ও বোনাস পাওয়ার পর পরেই সে বলবে আমার মা অথবা বাবা কখনও বলবে বউয়ের নারীঘটিত চিকিৎসা অতীব জুরুরী এখনই বাড়ি যেতে হবে। ঈদের বন্ধ শেষ হলেই অর্থাৎ স্কুল খোলার আগের দিন সে বলবে, আমি এখন আসতে পারবো না আমার আরও কয়দিন সময় লাগবে। এরই মধ্যে হয়তো সে অন্য কোথাও চাকুরীও নিয়েছে। তাহলে মায়েদের অবস্থা কী দাঁড়ালো –বোনাসও গেলো, ঈদের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে কোথাও ঘুরাফেরা হলো না, ইদের পরেও ড্রাইভার ছাড়া সন্তানদের স্কুলের যাওয়ার কী ব্যবস্থা হবে এই চিন্তায় মায়েদের রাতের ঘুম হারাম। নতুন করে ড্রাইভার নিয়োগ করা খুব কঠিন কাজ না হলেও অত্যন্ত ঝামেলার কাজ। অথচ ড্রাইভার হওয়ার কথা ছিল-অভিজ্ঞ এবং দক্ষ, যে আপনার গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের সমস্ত দিকের যত্ন নিবে। সমস্ত রাস্তা-ঘাট চেনা থাকার, কথাও যাওয়ার জন্য মায়েদের চিন্তা করার দরকার ছিল না। ড্রাইভার হওয়ার কথা ছিল স্থানীয় ট্যুর গাইডের মত যে, আপনাকে অপরিচিত জায়গাগুলি এবং আপনার গাড়িটিকে নিরাপদে ঘরে ফিরিয়ে আনতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং ওয়েল বিহেভড হবে। কিন্তু তা না হয়ে এরা মায়েদের জন্য বিষ ফোঁড়া হয়ে আসে। এই জন্য একটি সহজ হিসাব মায়েদের কাছে দাঁড়িয়েছে বুয়া থাকবে ৩ সপ্তাহ আর প্রাইভেট ড্রাইভার থাকবে সর্বোচ্চ ৩ মাস, এর বেশী আশা করা বোকামী। জিপিএ ৫: স্কুলে ছেলে বা মেয়েকে প্রথম হতেই হবে এমন একটি অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্য মায়েদের অস্থিরতার শেষ নাই। প্রতেক্যটা বিষয়ে কোচিং করাতে হবে, নিজের স্কুলের স্যার হলে তো খুব ভালো, কারণ প্রতিটি বিষয়ে ১০০ মার্কসের মধ্যে ১০০ পেতেই হবে, না হলে অন্যান্য ভাবীদের কাছে ছোট হয়ে যাবো, ভাবীদের কাছে ছোট হওয়ার চেয়ে বরং মারা যাওয়া অতি উত্তম। নিজের শরীর চলুক আর নাই চলুক, ছেলে ও মেয়েদের ভালো লাগুক আর নাইবা লাগুক জিপিএ ৫ বা গোল্ডেন ৫ বড় কথা। সংসারের টানা-পোড়ন বা মাসে কত টাকা খরচ হচ্ছে সেটার হিসাব আজকে নাইবা দিলাম। প্রতিটি পিতা-মাতা তাদের সন্তানদের তাদের পরীক্ষায় অসামান্য ফলাফল পেতে চান, কেউ এর চেয়ে কম আশা করেন না। যদিও গ্রেড সবসময় যোগ্যতার সূচক হয় না, তবুও মায়েদের অস্থিরতার শেষ নাই। কে শুনে কার কথা।সন্তানদের নিরাপত্তাঃ আজকের মায়েরা বাচ্চাদের নিরাপত্তাহীনতার নিয়ে অনেক বেশী উদ্বিগ্ন থাকে এবং সে কারণেই শহরাঞ্চলে, বিপুল সংখ্যক বাবা-মা তাদের বাচ্চাদের সাথে স্কুলে যায়। যদি কিছু ঘটে বা স্কুলের পরে সন্তানের কোনও খবর না পাওয়া যায় সেই কারণে মায়েদের সবসময় অস্থির থাকতে দেখা যায়। কয়েকদিন আগে পেপারে খবর বের হলো নেত্রকোনায় একদিনে তিন স্কুল-শিশু নিখোঁজ।এই নিয়ে ঢাকাস্থ মায়েরা সবাই আতঙ্কিত; ঢাকার বাইরে যদি এমন হয়, তাহলে ঢাকায় হওয়া তো খুব স্বাভাবিক। প্রত্যেকে ভেবেছিল তাদের অপহরণ করা হয়েছে। তবে সকলের দোয়ায় ও অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে পুলিশ তাদের খুঁজে পেয়েছিল এবং জনমনে স্বস্তি ফিরে এসেছিল। তিনটিই স্কুল-শিশুই সেদিন বলেছিল যে,স্কুল থেকে পড়াশোনার অত্যধিক চাপের কারণে এবং পিতামাতার তাদের মারধর করার কারণে তারা পালিয়ে গেছে। তারা বলেছে যে তারা এই শিক্ষামূলক চাপ চায় না। স্কুলের স্যারদের কাছে প্রাইভেট না পড়ানোঃ ইদানিং কিছু কিছু শিক্ষক তাদের কাছে প্রাইভেট না পড়লে, ক্লাসে উল্টা পাল্টা প্রশ্ন করে, যাতে ওইসব ছাত্র সেটির উত্তর দিতে না পারে, এর পর বকাবকি করা। এর প্রধান উদ্দেশ্যই হলো একটা মানসিক চাপ ওইসব ছাত্রের উপর তৈরী করা। এই সব কথা শুনে,মায়েদের রাতে না ঘুমতে না ঘুমতে ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়ার উপক্রম যে আমার মানসিক সমস্যা হয়েছে। এই ধরণের কিছু অনাকাংখিত ঘটনার কারণে মায়েদের অস্থিরতায় ভুগতে হয়।খাদ্যে ভেজালঃ আমাদের দেশে মায়েদের নতুন একটি অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে খাদ্যে ভেজাল । কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ছাড়াই বিভিন্ন কারখানায় (ভেজালযুক্ত খাবার সহ) উৎপাদন হয় যেটা প্রতি নিয়ত মায়েদের অস্থিরতা বাড়াচ্ছে । ইদানিং একটির একটি ভিন্ন প্যাটার্ন আমরা দেখতে পাই রমজানের কমপক্ষে দুই সপ্তাহ আগে বিএসটিআই, জেলা প্রশাসন, সিটি কর্পোরেশন এবং ভেজাল বিরোধী এজেন্সি সহ সরকারের দায়িত্বশীল এজেন্সিগুলি এই মহামারী মোকাবেলায় প্রচারণা চালায়, তার পরে প্রায় তারা চুপ করে যায়। এর ফাঁকে ভুয়া এবং ভেজাল পণ্য প্রস্তুতকারীরা কারখানা বা প্রতিষ্ঠান গুলো আরও আক্রমণাত্মক হয়ে উঠে এবং রমজানের ঠিক আগে,খাদ্যপণ্যের অসংখ্য কারখানা তৈরি হয় যেমন -শেমাই, নুডলস, মরিচ, মশলা এবং মটরশুটি ইত্যাদি। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে বিভিন্ন নামি-দামী ফাষ্টফুডের দোকানে তৈরী হয় বিভিন্ন প্রকার লোভনীয় ফাষ্টফুড যার প্রতি ছেলে-মেয়েদের ভীষণ আসক্তি এবং স্কুলের টিফিন ও বিকালের স্ন্যাকস সন্তানদের খাওয়ানো মায়েদের এক প্রকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ভেজাল পণ্যগুলিতে এলোমেলোভাবে মিশ্রণ জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক। খাদ্যপণ্য এবং ফলগুলিতে ক্ষতিকারক রাসায়নিকের ব্যবহারের কারণে, সাধারনত কিডনির কার্যকারিতা হ্রাস, যকৃতের ব্যর্থতা, ক্যান্সার এবং অন্যান্য রোগের ঝুঁকিসহ নানা রকম নতুন নতুন রোগের উপসর্গ নিয়ে আসে। ফলে মায়েরা যখনই কোন জিনিস কিনতে যায়, তখনই তাদের মধ্যে এক ধরণের অস্থিরতা কাজ করে কোনটি আসল আর কোনটি নকল বা ভেজাল। মাদকঃ আমাদের সমাজে মাদকের ভয়াবহতা নিয়ে মায়েদের মনে সন্তানদের জন্য ভয়ংকর একটা অস্থিরতা কাজ করে। শুনতে শুনতে এবং টিভি ও পত্রিকায় দেখতে দেখতে, এটি বাংলাদেশের রাজধানীতে একটি সাধারণ দৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে বা সাধারণ মানুষ এতটাই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে যে, যেখানে বেশিরভাগ লোকেরা তাদের সামনে উদ্ঘাটিত এসব ট্র্যাজেডিকে এড়িয়ে চলেছেন। ছেলে-মেয়েরা মাদকে আসক্ত হওয়ার বিভিন্ন কারণ সমাজে পরিলক্ষিত হচ্ছে –মোটা দাগে বললে সন্তানরা যখন বাবা-মার আদর-যত্ন থেকে বঞ্চিত হয়, পরিবারে সবসময় অশান্তি লেগে থাকলে, বাবা–মায়ের মধ্যে ডিভোর্সের মত ঘটনা ঘটলে, বাবা ও মা দ্বিতীয় বিবাহ করলে,অতিরিক্ত শাসন করলে ইত্যাদি। মাদকগুলির মধ্যে গাঁজা, হেরোইন, উত্তেজক বা ঘুমের ওষুধ, এই জাতীয় মাদক বাচ্চাদের মধ্যে বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয়। যে কোন মাদকের অভ্যাস সিগারেট দিয়ে শুরু হলেও ইদানিং ইয়াবা সেবন মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত শ্রেণির ছেলে-মেয়েদের মধ্যেও একটা ফ্যাসন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছেলে-মেয়েদের বন্ধু নির্বাচনঃ স্কুল কলেজে ছেলে-মেয়েদের জন্য বন্ধু নির্বাচন একটি কঠিন বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ মায়েদের মধ্যে সবসময় এক ধরণের অস্থিরতা কাজ করে , সন্তানেরা কার সাথে মেলা মেশা করতেছে, তারা ভালো না মন্দ বুঝার কোন উপায় নাই । কারণ বর্তমানে প্রযুক্তির যুগে তাদের কাজ কারবার মায়েরা বুঝতেও পারেনা।তাছাড়া সমাজে এখন বহু ধরণের গ্রুপের কথা যায়। এসব গ্রুপের নাম নাইবা উল্লেখ করলাম। যদিও এসব গ্রুপের নাম মায়েরা ১৯৯০ সাল থেকে শুনতেছে এবং ইদানিং রাজধানীর একটি অভিজাত এলাকার মর্মান্তিক ঘটনা ছেলে-মেয়েদের জন্য বন্ধু নির্বাচননের বিষয়টিকে আরও অস্থির করে তুলেছে। রাস্তায় গাড়ী পার্কিং: ঢাকা শহরে রাস্তায় গাড়ী পার্কিং জন্য ৪২টি পয়েন্ট নির্বাচন করা হয়েছে। কথায় কোন পয়েন্ট আমার মনে হয় কোন মা কেন বাবারাও হয়তো হলফ করে বলতে পারবেন না। নগরীর পার্কিং ব্যবস্থায় কোথাও কোনও শৃঙ্খলা নেই। যথাযথ পরিকল্পনা ও পর্যবেক্ষণের অভাবে পর্যাপ্ত পার্কিংয়ের জায়গা ছাড়াই নগরীর বিশাল সংস্থাগুলি ইতিমধ্যে নির্মিত হয়েছে। আর স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, ডায়াগনোসিস সেন্টারের কথা না বলাই ভালো। ডিএমপির অর্ডিন্যান্স রাস্তায় বা সর্বজনীন স্থানে পার্কিং নিষিদ্ধ করেছে এবং ১০০০ টাকা জরিমানার ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে ছেলে-মেয়েদের স্কুল থেকে আনার সময়, হাসপাতালে ও ডায়াগনোসিস সেন্টারে কোন কাজে গেলে গাড়ী পার্কিং মায়েদের জন্য বিশাল একটি অস্থিরতার কারণ হয়েরে দাঁড়াচ্ছে । গাড়ী রাখতে হয় এক খানে, প্রয়োজনীয় কাজ সারতে হয় অন্যখানে। ঢাকা শহরের ফুটপাতের রাস্তার কথাতো আমরা সবাই জানি, নানা রকম খানাখন্দকে ভরা আর ছেলে-মেয়েদের স্কুল ব্যাগের ভারীর কথা স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত অবগত আছেন। একদিকে সন্তানের হাত, অন্যদিকে বিশাল স্কুল ব্যাগ বহন করা, মায়েদের জন্য কঠিন এক কাজ। তাই ইদানিং গাড়ী পার্কিং করা নিয়ে, মায়েদের অস্থিরতার শেষ নাই, কারণ একটু এদিক ওদিক হলেই পুলিশি হয়রানি ও জরিমানার শিকারের দিকটা তো আছেই । ছেলে-মেয়েদের উপর মোবাইল ফোনের প্রভাব: ইদানিং ছেলে-মেয়েদের উপর মোবাইল ফোনের প্রভাব মারাত্মকভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। মোবাইল ফোনের সাহায্যে তারুণ্যের সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনের ধরণগুলি পরিবর্তিত হচ্ছে।ফলে মায়েদের অস্থিরতা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। যদিও আমরা জানি প্রযুক্তিগত অগ্রগতি বৃহত্তম সামাজিক প্রভাব তৈরি করে। আজকাল মোবাইল ফোন পছন্দ করে না বা বাসায় মোবাইল ফোন থাকবে না,স্কুল কলেজ গোয়িং ছেলে-মেয়েদের কাছে এটা কল্পনারও বাইরে। ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশে সেল ফোন প্রবর্তনের পরে,আজ পর্যন্ত যা আমরা দেখতেছি তাতে স্কুল-কলেজ গোয়িং ছেলে-মেয়েরা রাস্তায়, বাসে, দোকানপাটে, রেস্তোঁরাগুলিতে, এমনকি লাইব্রেরিতেও অর্থাৎ সমস্ত ক্ষেত্রে মোবাইল ফোনে ব্যবহার করে। মাঝে মাঝে সোশাল মিডিয়া যেমন- ফেসবুক, ইউটিউব, মেসেঞ্জার, হয়াট‘স এপ, ভাইবার, ইনষ্টাগ্রাম ও ইমোর প্রতি ছেলে-মেয়েদের আসক্তি এমন বেড়ে যাচ্ছে যে, মায়েদের অস্থির না হয়ে কোন উপায় থাকে না। উবার মোটর সাইকেলঃ বর্তমানে মায়েদের অস্থিরতার অন্যতম একটি কারণ উবার মোটর সাইকেলের দৌরাত্ম্য। এদের কাছে কোন মা- বাবা, শিশু-বৃদ্ধ ও স্কুল- কলেজ গোয়িং ছেলে-মেয়ে বলতে কিছু নেই। সুযোগ পেলেই উপর দিয়ে মোটর সাইকেল নিয়ে যায়, এমন অবস্থায় দাঁড়িয়েছে। এরা কোন লেন, উল্টা-সোজা মানে না, রাস্তার ফুটপাত যেখান দিয়ে মায়েরা স্কুল থেকে সন্তানদের আনতে যায়, এটিই হলো তাদের সবচেয়ে পছন্দের রাস্তা। এমনভাবে মায়েদের পিছনে এসে হর্ণ দেয়, কিছু কিছু মা ভয়ে চিল্লায় উঠে, কোন কোন মায়েদের পার্টস হাত থেকে পড়ে যায়, অনেক মায়েদের হাঁটার সময় ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়, এই বুঝি উবার মোটর সাইকেল গায়ের উপর উঠলো অথবা ছেলে-মেয়েদের স্কুল ব্যাগ উবার মোটর সাইকেলের হ্যান্ডলে লেগে তার প্রাণ প্রিয় সন্তানটি মাটিতে পড়ে আঘাত পেলো। এই ধরণের নানা রকম কারণে ঢাকাস্থ মায়েদের দৈনন্দিন অস্থিরতার কোন শেষ নেই। আশা করি আমাদের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত হবে এবং সরকার একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে ঢাকাস্থ মায়েদের অস্থিরতার কারণগুলি সনাক্ত করে, অবসানের একটি দিক নির্দেশনা তার অধিনস্ত বিভাগগুলিকে দিবেন, তাহলে ঢাকাস্থ মায়েদের হয়তো একটু স্বস্তি ফিরবে। ঢাকা একটি সুষ্ঠু ও সুন্দর, বসবাস যোগ্য ও চলাচল উপযোগী শহর হিসাবে গড়ে উঠুক এবং ঢাকাস্থ মায়েদের অস্থিরতাগুলো দূরীভূত হউক একজন সাধারণ নাগরিক হিসাবে এটিই আমার প্রত্যাশা।

লেখকঃ
কৃষিবিদ মোঃ আব্বাস আলী
ডিরেক্টর- এক্সপ্লোর বিজনেস লিমিটেড।

Facebook Comments