মায়ের টানে

0
1322

মায়ের টানে

– এম. এ. হান্নান

১৯৬৬ সালের জুলাই, সম্ভবত বাংলা আষাঢ় মাস, ঘোরতর বর্ষা। নির্জন-নিঝুম অমাবশ্যার মধ্যরাত। চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। বৃষ্টি ঝড়ছে মুষলধারে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের চমকানিতে চোখ ঝলসে যায়। সেসময় আমি ঠাকুরগাঁও বি.ডি. কলেজে আই.এস-সি. শেষবর্ষের ছাত্র। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সর্বউত্তরের থানা তেঁতুলিয়ার সাড়েতিন কিলোমিটার উত্তরে কালারামজোত গ্রামে আমার বাড়ি। দিনাজপুর থেকে ছেড়ে আসা সবশেষের বাসটিতে চেপে আনুমানিক রাত সারে এগারোটায় এসে পৌঁছালাম তেঁতুলিয়ায়। উল্লেখ্য, সেসময় বাইরে কোথাও গেলে তেঁতুলিয়া বাজারস্থিত আইয়ুব মিয়ার হোটেলে (বর্তমান উপজেলা ভূমি অফিস, তখন ছিল বাসস্ট্যান্ড), নয়তো থানার পাশে স্বনামধন্য ব্যবসায়ী আইনুল ভাইয়ের বাসায় প্রায়ই সাইকেল রেখে যেতাম। সেদিন সকালে বাড়ি থেকে ঠাকুরগাঁও যাবার পথে যথারীতি সাইকেলখানা আইনুল ভাইয়ের বাসায় রেখে গেছিলাম। যাহোক, সেখান থেকে সাইকেল নিয়ে রাত পৌনে বারোটার দিকে বৃষ্টিতে একরকম ভিজেই বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম। বাড়ি যে আমায় পৌঁছাতে হবেই। মাকে কথা দিয়েছি, আজই ফিরবো। বাড়ি না ফেরা অবধি পথ পানে চেয়ে থাকবেন আমার মা। কোনো কারণে আমার ফেরা না হলে সে রাতে যে তাঁর ঘুম হবে না। ঘুটঘুটে অন্ধকারে মায়ের কথা ভাবছি, আর পথ চলছি। এক হাতে সাইকেলের হ্যান্ডেল, অন্য হাতে ছাতা। থানার পাশ দিয়ে এগুচ্ছি উত্তর দিকে। রাস্তার অবস্থা সঙ্গিন। একটু অসাবধান হলেই প্রপাত ধরণিতল। থানা পার হলেই সামনে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ঘন জঙ্গল। কোনো ইংরেজ সাহেবের পুরোনো বাংলোর ভগ্নাবশেষ ঘেষে রাস্তার দু-ধারে সুউচ্চ নানা জাতের গাছ। বিশেষ করে এলাকাটি লিচু আর আম-কাঠালের বাগানে ভরা। মাঝে মাঝে তেঁতুল গাছ। সবগুলোগাছ আকাশচুম্বী। থেকে থেকে বিদঘুটে পেঁচা আর শেয়ালের ডাক শুনে লোম শিউরে ওঠে। এর পরেই রাস্তার গা ঘেঁষে পশ্চিম দিকে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে গোরস্থান। পূবদিকে গহিন জঙ্গল, বর্তমানে এটি সরকারি ফরেস্ট এবং মাঝে ফরেস্ট বাংলো। তেঁতুলিয়া থানার বাজার, বসতবাড়ি, কাচারি, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষ করে ডাকবাংলোর বিস্তীর্ণ এলাকা বেশ উঁচু। ছোটোবেলায় রূপকথার গল্পে শুনেছিলাম- এলাকাটি কোনো এক সময় হিমালয় পর্বতমালারই একটি অংশ ছিল। কি করে এটি বিচ্ছিন্ন হয়েছিল তা বলতে পারবো না। এ জন্যই এলাকাটি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যে ভরা ও স্বাস্থ্যকর। আর সম্ভবত সে কারণেই ইংরেজ সাহেবরা এখানে বসতবাড়ি ও রেস্ট হাউস বা বাংলো নির্মাণ করেছিলেন। তেঁতুলিয়া নামকরনের অন্তরালে রয়েছে, অত্র এলাকায় একসময় প্রচুর তেঁতুল গাছ ছিল এবং তেঁতুল নিয়ে একটি উপাখ্যানও প্রচলিত আছে একারণে অত্র থানার নামকরণ করা হয়েছিল তেঁতুলিয়া। আবার কেউ কেউ বলেন, তিতু আউলিয়া নামে জনৈক পীর-দরবেশ এর নামানুসারে নাকি তেতুলিয়া নামটি এসেছে। সে যা’হোক, বহু আগে থেকে এলাকাটি উঁচু হবার পাশাপাশি প্রচুর ফলবান বৃক্ষে ভরা ছিল। মহানন্দা নদীর তীরে বাজার-ঘাট, বিভিন্ন অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, থানা, থানার পূর্ব পাশে প্রশস্ত খেলার মাঠ, নানা জাতের ফলবান গাছের সমাহার, সাহেব-বাড়ি, ডাকবাংলো, মনোরম আবহাওয়া- সবকিছুই এ থানার ঐতিহ্য। আমি যে রাস্তা দিয়ে চলেছি তার পশ্চিমে অনতিদূরেই মহানন্দা নদী বয়ে চলেছে কুলকুল রবে। এখনকার মতো তখন মহানন্দা নদীর এমন করুণ অবস্থা ছিল না। নদী ভরাট থাকতো, মাছও পাওয়া যেতো প্রচুর। বর্ষায় তো নদী পার হওয়া ছিল দূরূহ বিষয়।
শৈশবে বয়োবৃদ্ধজনের মুখে শুনেছি এক সময় থানার পাশে এবং পুরাতন বাজারের পশ্চিমে নদীর ঘাটও ছিল; নৌকায় করে লোকজন, গাড়িঘোড়া, মালামাল পারাপার হতো। যেটির চিন্তা এখন কল্পনাতীত। নদীর তীরে পাহাড়ের মতো উঁচু টিলার উপরে তেঁতুলিয়া ডাকবাংলোটি
এখনো স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে। তবে তার চার পাশে বিশেষকরে পশ্চিম পাশে প্রশস্ত উচু যায়গাগুলো এখন নদী গর্ভে বিলীন। বাংলোর দিকে যাবার পথে রাস্তার পূর্বদিকে পাতা ছিল একটি ভাঙা লোহার ফাঁদ। একসময় এ ফাঁদে বাঘ ধরা হতো। মানুষজনের চলাচলের জন্য ডাকবাংলো এবং গোরস্থানের মধ্যদিয়ে খাড়া সরু রাস্তা অন্তত কুড়ি-পঁচিশ ফুট নিচদিকে ঢালু হয়ে নেমে গেছে। দূর থেকে এটিকে সুড়ঙ্গ পথ বললেও ভুল হবে না। যদিও বাংলোর পূবে বেশ দূরদিয়ে একসময় বর্ধমান রোড ( কলকাতা টু দার্জিলিং ) নামে একটি রাস্তা ছিল (যেটি বর্তমানে সচল ও ব্যস্ততম রাস্তা। কিন্তু সে সময় ঐ রাস্তা ছিল দুর্গম, ভয়াবহ এবং জনশূন্য গহিন জঙ্গলে ভরা। প্রায় এক কিঃমিঃ রাস্তা বড় বড় উচুগাছ ছাড়াও ঝোপঝাড় আর বাঁশবাগানে ঘেরা ছিল। সে রাস্তা দিয়ে দিনের বেলাতেও মানুষজন চলাচল করতে ভয় পেতো। বাঘ-শিয়াল ছাড়াও ভূতপ্রেত ও চোর-বদমাশের ভয় তো ছিলই। বিশেষকরে রাতে একাকী এ রাস্তা পাড়ি দেয়া ছিল আরো বিপদজনক। এমনকি বর্তমানে যেস্থানটিতে তেঁতুলিয়া বাজার, মসজিদ, চৌরাস্তা, হাসপাতাল গড়ে উঠেছে সেসময় সেটি ছিল সুউচ্চ গাছপালা, বনজঙ্গলে ভরা। বর্তমান প্রেক্ষাপটে পূর্বাবস্থা আঁচ করা কল্পণারও অতীত। তাছাড়া আমার সাইকেল রাখা ছিল থানার পাশে আইনুল ভাইয়ের বাসায়। তাই অনন্যোপায় হয়ে চলতে হলো থানার পাশ দিয়ে বন-জঙ্গল ঘেড়া পুরনো সাহেব-বাড়ী হয়ে গোড়স্থান ও ডাকবাংলোর পাশদিয়ে ঢালুতে নেমে যাওয়া এ সুড়ঙ্গ পথ দিয়েই। চলন্ত পথে নানা স্মৃতি আর কল্পকাহিনির কথা উঁকি দিচ্ছে মনে। মনে পড়লো, তেঁতুলিয়া সরকারী মডেল স্কুলে পড়ার সময় বাংলোর চৌকিদার বাড়িতে ঘটা একটি লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের কথা। রাত দূরে থাক, দিনের বেলাতেও একা একা এস্থান দিয়ে চলাচল করার সময় মনে পড়ে যায় সেসব ঘটনার কথা। যতোই সামনে এগুচ্ছি, ততোই নতুন-পুরাতন কবরের বাসিন্দাদের কথাসহ আজগুবি অনেক কল্পকথা স্মৃতিপটে ভেসে আসছে একের পর এক। ভাবা যায়? রাত বারোটায় মুষলধারে বৃষ্টির অমাবস্যা রাতে আমার মনের অবস্থা! তবুও বাড়ি যে আমায় ফিরতেই হবে এবং একমাত্র সে রাস্তা দিয়েই!
যাহোক, যতোই সামনে এগুচ্ছি ভয়ে ততোই শরীরের লোম খাড়া হচ্ছে। এভাবেই এগিয়ে চলেছি সেই ভয়াবহ অকুস্থলের দিকে। এখানে গোরস্থানটি রাস্তা প্রায় ছুঁই ছুঁই করছে। রাস্তার দুপাশে প্রকাণ্ড আম-কাঠালের বাগান ছাড়াও ছোটো-বড়ো অনেক ঝোপঝাড়ের মধ্যদিয়ে এগিয়ে চলছি সামনে। অবশেষে সেই সন্ধিক্ষণ ঘনিয়ে এল। পাশেই পুরাতন একটি কবরের উপর একটি ফুটকি গাছ। হঠাৎ গাছের পাতা নড়ে ওঠার খসখস শব্দ পেলাম। আচমকা সাইকেল ব্রেক করে একপায়ে দাড়ালাম। ভয়ে গায়ের লোম একেবারে খাড়া! আবার ভাবছি ওটা কিছু না। পুনরায় সামনে এগুনোর চেষ্টা, দৈবাৎ আমার সামনে দিয়ে কালো সাপের মত কি যেন একটা সরসর শব্দ করে চলে গেল। ওদিকে তড়িঘড়ি করে ঢালু পথে সামনে এগুতেই সাইকেলের সামনের চাকায় কি যেন ধাক্কা খেল, আর ধাক্কা না খেয়েই চাকা পিছলে চিৎপটাং! আমি পড়লাম বাঁয়ে, সাইকেলটা ডানে, আর ছাতাটি উড়ে গিয়ে উল্টে পড়লো আর এক জায়গায়। এরপর কি হলো বলতে পারব না। অন্তত পনের কুড়ি মিনিট সেভাবেই কাটলো। যখন সম্বিত ফিরে পেলাম, দেখি বাম পাটা আর নাড়াতে পারছি না, কোনোমতেই না। একপর্যায় অনেক চেষ্টা-তদবির করে উঠে দাঁড়ালাম, কিন্তু ডান পায়ের সেন্ডেল কই? সেন্ডেল খোঁজার জন্য অন্ধকারে এদিক-ওদিক হাতরাচ্ছি। হাতরাতে হাতরাতে যা হাতে এলো তা ধরে দেখি, একহাতে একটি সেন্ডেল আর অন্য হাতে আধমরা একটি ব্যাঙ। নড়ছে একটু একটু। ছুঁড়ে ফেললাম! আর এদিকে শরীরে শুরু হলো কাঁপুনি। বুঝতে বাকি রইলোনা, সাপের মতো কালো জিনিসটা আসলেই একটা সাপ ছিল। ব্যাঙ শিকার করছিল। এ রাস্তা দিয়ে দিনেরবেলা চলাচল করার সময়ও প্রায়ই সাপের দেখা পাওয়া যেতো। এরইমধ্যে পুরো শরীর আর জামাকাপড় ভিজে জবজব। কি আর করি? ঐ অবস্থাতেই বহুকষ্টে সাহস সঞ্চার করে সাইকেল, সেন্ডেল এবং ছাতা খুঁজে নিয়ে সেই সরু ও জনশুন্য অন্ধকার রাস্তা দিয়ে বাড়ির পানে হাঁটার চেষ্টা করলাম। তেমন হাঁটতেও পারছি না। বাম পায়ে বেশ চোট পেয়েছি। একরুপ খোঁড়াতে খোঁড়াতে কর্দমাক্ত রাস্তা পারি দিয়ে উঠলাম বর্ধমান রোডে। এখানে বনজঙ্গল তেমন একটা না থাকলেও এলাকাটি বেশ নির্জন এবং ভীতিকর। উপরন্তু সেসময় এ এলাকায় চোর-বদমাশের ভয় তো ছিলই। কিছুদূর যেতে না যেতেই পেলাম আর একটি গোড়স্থান। তবে একটু দূরে। এক সময়ের বর্ধমান রোড এখন খানাখন্দকে ভরা। তাই, এই জনশুন্য অন্ধকার রাস্তা ভয়ভীতি নিয়েই কখনো পায়ে হেঁটে আবার কখনো সাইকেলে চেপে এগুচ্ছি। প্রতিবছর বর্ষা এলেই একসময়ের সেই পাকা রাস্তার এমনই করুণ দশা হয়। যাহোক, ইতোমধ্যে সর্দারপাড়া গ্রামের ঠিক পশ্চিমে এসে পৌছেছি। উল্লেখ্য, এখানে মহানন্দা নদী বর্ধমান রোড থেকে মাত্র ১০০ গজ দূরে। নদীর ধার সমতল ভুমি থেকে বেশ উচু। বর্ধমান রোড সংলগ্ন সেই উচু টিলাসম বিস্তীর্ণ জায়গা জুরে গোরস্থান। গোড়স্থানের পাশে দু’চারটা খেঁক শিয়াল এদিক ওদিক দৌড়াতে দেখলাম। শিয়ালগুলো একটু দূরে গিয়ে হাঁক মারলো- ‘হুক্কাহুয়া-হুক্কাহুয়া, ‘কিয়াহুয়া-কিয়াহুয়া’। আর অমনই অন্তত কুড়ি-পঁচিশটি খেকশিয়াল ডাক দিয়ে উঠলো একই রবে। ভাবলাম, যদি ওরা আমার দিকে আসে, তবে আমার বিধি-বাম! ভাগ্যিস, ওরা তা’ করে নি।—— এমনইকরে নানান দূর্দশার মধ্য দিয়ে একসময় বাড়ি এসে পেঁৗঁছালাম। মায়ের ঘরের কাছাকাছি আসতেই মাকে ডাকলাম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য যে, তিনি জেগেই ছিলেন আমার অপেক্ষায়! সত্যি সত্যিই প্রাণপ্রিয়া মা আমার ঘুমোননি! কঠিণ আত্ম-বিশ্বাস ও সন্তানের ভাবনায় তিনি জেগে ছিলেন আমার ফিরে আসার অপেক্ষায়। একবার ভাবুন তো, আমি সে রাতে ফিরে না এলে উনি কি সারারাত ঘুমোতে পারতেন? এরপর মা আমায় বড় আদরকরে পেটপুরে খাওয়ালেন, আর আমি ঐফাঁকে তাঁর নিকট ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলোর আদ্যপ্রান্ত বর্ণনা করলাম। তিনি আমার বর্ণনা শুনছিলেন এবং বিস্ময়ে বিহ্বল, আতঙ্কিত ও শিহরিত হচ্ছিলেন। বর্ণনার একপর্যায়ে মা-ছেলে উভয়ের চোখ দিয়ে স্বস্তি ও আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়লো! এমনইতো ছিলেন আমার মা! এমন মায়ের টান কখনো ভোলা কি যায়?

লেখকঃ এম এ হান্নান

( লেখকের  জীবনের বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে লিখা একটি স্মৃতিচারণমূলক গল্প )

—– ০ —–

 

Facebook Comments