একটি কুঁড়ি দুটি পাতা ও পঞ্চগড়ের পরবর্তী বংশধরের জন্য সতর্কতা

পঞ্চগড় জেলার মোট ব্যবহার যোগ্য জমির পরিমাণ ২ লক্ষ ৮১ হাজার ৪৯৩ একর (উৎসঃবিবিএস- ২০১১) সবসময় ফসল হয় প্রায় ৬ হাজার ৬৩৮ একর জমিতে, মাঝে মাঝে ফসল করা হয় প্রায় ২ লক্ষ্য ৩৭ হাজার ৩৫০ একর জমিতে, স্থায়ীভাবে পতিত পরিমাণ ২৪ হাজার ১৬৬ একর এবং অন্যান্য জমির পরিমাণ ২৪ হাজার ৭৭ একর জমি। আমরা জানি, বাংলাদেশের চা চাষকে মূলত ৩টি অঞ্চলে ভাগ করা হয়। প্রথমটি হলো সুরমা ভ্যালি অর্থাৎ বৃহত্তর সিলেট অঞ্চল, দ্বিতীয়টি হলো হালদা ভ্যালি, বৃহত্তর চট্রগ্রাম অঞ্চল ও তৃতীয়টি হলো করতোয়া ভ্যালি অর্থাৎ পঞ্চগড় জেলা এবং উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল। আমার লেখাটি মূলত পঞ্চগড় জেলার চা চাষকে কেন্দ্র করেই। বাংলাদেশে ১৬২টি বাগানে মোট ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে চা চাষ হচ্ছে । এর মধ্যে পঞ্চগড়ে প্রায় ৭৪৫ হেক্টর জমিতে অর্থাৎ ১৮৪০ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে। জেলা পরিসংখ্যান-২০১১, পঞ্চগড় এর হিসাব অনুযায়ী একটি খামার হোল্ডিংকে একটি কৃষি উৎপাদন ইউনিট হিসাবে ধরা হয়েছে যার ন্যূনতম চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ০.০৫ একর বা ৫ শতক জমি আছে । খামার হোল্ডিংগুলিকে তিনটি ভাগে শ্রেণিবদ্ধ করা হয়েছে: (ক) ছোট: যার চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ০.০৫ একর বা ৫ শতক থেকে ২.৪৯ একর পর্যন্ত। (খ) মাঝারি: ২.৫০ থেকে ৭.৪৯ একর (গ) বৃহৎ: যার চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ৭.৫০ একর বা তারও বেশী। যাদের জমির পরিমাণ ০.০৫ একর বা ৫ শতক, এই সব পরিবারের জমি সাধারণত: শাকসব্জি উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়। যেমন-লাউ,চাল কুমড়া,মিষ্টি কুমড়া ও অন্যান্য সব্জি যেগুলি সাধারণতঃ লতা জাতীয় হয় এবং এই লতাগুলি বাড়ির ছাদ এবং অন্যান্য কাঠামোর চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে।বর্তমানে বাংলাদেশে সারা বছর মোট চা উৎপন্ন হয় প্রায় ৭৮.৯৫মিলিওন কেজি( ৭৮ হাজার ৯৫০ মেট্রিক টন),কনজামশন হয় প্রায় ৮৫.৯৩ ৯৫মিলিওন কেজি( ৮৫ হাজার ৯৩০ মেট্রিক টন) এবং বিদেশ থেকে আমদানী করতে হয় প্রায় ৬.৯৪ মিলিওন কেজি অর্থাৎ ৬ হাজার ৯৪০ মেট্রিক টন(উৎসঃ ঢাকা ট্রিবিউন,২০শে ফেব্রুয়ারী-২০১৮)। চা হল একটি ক্যালসিফিউজ ফসল যাতে তুলনামূলকভাবে কম পরিমাণে ক্যালসিয়ামের প্রয়োজন, তবে পটাসিয়াম এবং সিলিকনের বেশি পরিমাণ প্রয়োজন। চা পলি, পিটযুক্ত ও এসিডিক বা অম্লীয় মাটিতে জন্মাতে বেশী পছন্দ করে। যার উত্তম পিএইচ পরিসীমা ৪.৫ থেকে ৫.০। পঞ্চগড়ের মাটি উপরোক্ত বিষয়গুলির জন্য বেশ জুতসই। আমরা জানি চা গাছের জীবন কাল প্রায় ৩০-৫০ বছর,যদিও চীনারা দাবি করেন কোন কোন গাছ ১ হাজার বছর পর্যন্ত বাঁচে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন পঞ্চগড়ের অনুকূল আবহাওয়া এবং মাটির গুনাগুন চা চাষ বাড়ানোর জন্য বেশ ভালো।
বাংলাদেশ চা বোর্ড, পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয়ের চা উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন বলেন (উৎসঃ NEW AGE 2,August-2014), পঞ্চগড়ে চা চাষ ২০০০ সালে শুরু হয়েছিল যার উৎপাদন ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে,ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের পাশাপাশি দরিদ্র মহিলাদের সহ সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে এই খাতটির দ্রুত বিকাশ হচ্ছে। যার কারণে সকল জমির মালিকগণ জমির ধরণের কথা চিন্তা না করেই চা চাষের দিকে ঝুঁকে পড়ছে।এক বিঘা জমিতে চা উৎপাদন করতে খরচ হয় প্রায় ৫০ হাজার টাকা, প্রতি বার যদি ১১০০ কেজির মত চা পাতা উত্তলন হয়, এই ভাবে ৬ বার পর্যন্ত চা পাতা তোলা যায় , তাহলে মোট বিক্রয় মূল্য দাঁড়ায়=১১০০x৬ x১৬.৮০ = ১,১০,৮৮০ টাকা, খরচ বাদ দিলে লাভ দাঁড়ায়=৬০,৮৮০ টাকা। এই ১ বিঘা জমিতে দুই বার ধান উৎপাদন করলে ৩৬ মনের মত ফলন হতো, যার বিক্রয় মূল্য ১৮ হাজার টাকা, খরচ বাদ দিয়ে লাভ হয় ৪ হাজার টাকার মত,ধানের তুলনায় চা প্রায় ৮৮% বেশী লাভ, ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে সাথে সাথে পেমেণ্টও পাওয়া যায় । অন্যদিকে সমতল ভূমিতে চা চাষ করা যায় এবং ক্যাশ ক্রপ হওয়ার কারণে ছোট, প্রান্তিক ও সাধারণ মানুষকে চা চাষ ব্যাপক ভাবে আকর্ষণ করছে। যার কারণে প্রতি বছরে পঞ্চগড় জেলায় চা চাষের এরিয়া বাড়ছে। ফলশ্রুতিতে মাত্র ২০০০ সালে শুরু হওয়া চা চাষ পঞ্চগড় জেলাকে প্রায় ২৯৭টি ছোট, ১০টি মাঝারি এবং ২২টি বড চা বাগানে রূপান্তরিত করেছে। যা থেকে প্রায় ১ হাজার টন চা উৎপাদন। বাংলাদেশে দুই ধরণের জমি আছে, কৃষি জমি ও অকৃষি জমি। কৃষি জমির মধ্যে আবার নাল, ডোবা ও ধানী আছে।বাণিজ্যিক ভাবে চা চাষ পঞ্চগড়ের শত শত মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাচ্ছে, নি:সন্দেহে এটি ভালো দিক এবং এই সেক্টরে প্রায় ১০ থেকে ১১ হাজার লোকের কর্ম সংস্থান হচ্ছে এবং যার মধ্য প্রায় ৭ হাজারের ৫০০ মত অসহায় ও বেকার মহিলাও আছে((উৎসঃ NEW AGE 2,August-2014)। পঞ্চগড়ে প্রায় ৭৪৫ হেক্টর জমিতে অর্থাৎ ১৮৪০ একর জমিতে চা চাষ হচ্ছে এবং পরিসংখ্যান বলছে, স্থায়ীভাবে পতিত পরিমাণ প্রায় ২৪ হাজার ১৬৬ একর। এই সব জমিতে চা চাষ বাড়ুক তাতে কোন ভয়ের কোন কারণ নাই। কিন্তু আমার ভয়ের কারণটি আসলে যে সব জমিতে ধান উৎপাদন করা সম্ভব এবং প্রচুর পরিমাণে শাক সবজি উৎপন্ন হয় এমন জমিতে চা চাষ করা নিয়ে, এমন সব জমিতে চা চাষ না করাই ভালো এবং আমাদের এখনই নিরুৎসাহিত করা উচিত। ধরুন যাদের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ০.০৫ একর বা ৫ শতক থেকে ২.৪৯ একর এবং এই জমিতে প্রচুর ধান ও শাক সবজি উৎপন্ন হয়, উনারা যদি এই সব ফসল চাষাবাদ না করে অধিক লাভের আশায় চা চাষ করে, তাহলে এখন হয়তো আমরা এর ক্ষতিকর দিকটা বুঝতে পারছি না কিন্তু আজ থেকে ২৫-৩০ বছর পর আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধর মহাসমস্যায় পড়বে। কারণগুলি হলো আজকের ১ একর জমির চা চাষ মানে আগামী ২৫-৩০ বছর অন্য ফসল করার সুযোগ নাই। তাছাড়া প্রুনিং করা চা গাছের জন্য অত্যন্ত জুরুরী, গাছের গ্রোথ কমিয়ে রাখা ও নতুন কুশি বেড় হওয়ার জন্য এটি নিয়মিতভাবে ম্যানেজ করা গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ। এটি দুইটি সাইকেলে করতে হয় ১টি ৩ বছরের সাইকেলে, এই সাইকেলে হালকা প্রুনিং, হালকা স্কীফ, ডিপ্ স্কীফ। আর ১টি ৪ বছরের সাইকেলে হালকা প্রুনিং, ডিপ্ স্কীফ , মিডিয়াম স্কীফ ও হালকা স্কীফ। চা চাষের জন্য গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া অত্যন্ত প্রয়োজন। তা ছাড়া ১৮–২৯ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা ও সারা বছর সমভাবে ১৪০০ মিলি মিটার বৃষ্টি পাতের প্রয়োজন। আমরা জানি ইদানিং পৃথিবীর তাপমাত্রা দিন দিন বাড়ছে, জল বায়ুর পরিবর্তনের কারণে সময় মত বৃষ্টি পাত হচ্ছে না, অতিরিক্ত সেচের কারণে ভূগর্ভস্থ পানির পরিমাণও কমে যাচ্ছে, দিন দিন প্রচুর মানুষ গার্মেণ্টস ও বিদেশ চলে যাওয়ার কারণে লেবার ক্রাইসিস প্রকট হয়ে উঠছে। এ ছাড়া নিত্য নতুন রোগ ও পোকা মাকড় আক্রমনতো আছেই। প্রকৃতিগত কারণে ৩ -৪ সাইকেলের পর চা গাছের পাতা প্রদান করার ক্ষমতাও কমে যাবে। ফলে তখন এইটা আর লাভজনক থাকবে না। তাছাড়া সে দিন হয়তো বেশী দূরে নয় , যখন প্রচুর চা উৎপন্ন হবে কিন্তু সে তুলনায় চাহিদা কমে যাবে বা চা ফ্যাক্টরিগুল ঐ পরিমাণ ক্রয় করতে পারবে না। তখন যাদের চাষযোগ্য জমির পরিমাণ ০.০৫ একর বা ৫ শতক থেকে ২.৪৯ একর, তাদেরের বিকল্প কিছু করার থাকবে না এবং ছোট ছোট জমির মালিকগুলি লোক শানের দিকে ধাবিত হবে, আর সহসায় তাদের জন্য অন্য ফসল করাও সম্ভবও হবে না এবং খুব দ্রুত এই সব জমিকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনাও সম্ভবর হবে না। কারণ ততদিনে এই সব জমির গঠন, বুনট ও পানি ধারণ ক্ষমতা নষ্ট হয়ে যাবে। ১৮৩৭ সালে প্রথম যে চা বাগানটি আসামের চাবুয়া গ্রামে করা হয়েছিল, সেই গ্রামে আমি গিয়েছি(The first tea garden was established in 1837 at Chabua in Upper Assam. Close to 1840, the Assam tea company started a commercial of tea in the region) এবং সেই সুবাদে বহু চা বাগান পরিদর্শন করেছি এবং রতন টাটা ও জেমস ফিনলের চা বাগানের ম্যানেজারের সাথে কথা বলেছি এবং রতন টাটার চা বাগানের ম্যানেজারের সাথে সারাদিন ঘুরেছি ও মিটিং করেছি। জোরহাট,আসামে অবস্থিত -টোকলাই চা গবেষণা কেন্দ্রও পরিদর্শন করেছি(The Tocklai Tea Research Institute was established in 1911, at a site near the River Tocklai in Jorhat, Assam. The initial construction of a laboratory and two bungalows was funded by the tea industry, subsidised by the national government of India, and the Indian states of Assam and Bengal)। সেই সময় আমি দেখেছি শত শত একর পুরাণ চা বাগান পড়ে আছে এবং নতুন করে চা প্লান্টেশনের কোন সুযোগ নাই, কারণ বর্তমানে যে গুলি ভালো আছে সেইগুলিই এখন লুজিং কনসার্ন ।লুজিং কনসার্ন হওয়ার প্রধান কারণসমূহ হলো- নতুন নতুন পোকার আক্রমন, শ্রমিক সংকট, শ্রমিক অসন্তোষ,কম প্রডাক্টিভিটি। তাই পঞ্চগরেড় চা চাষের সাথে যারা জড়িত আছেন,যেমন-কর্মকর্তা, বড় বড় চা বাগানের মালিক, জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষিত জনন্গোষ্ঠির প্রতি আমার অনুরোধ – যে সব জমিতে ধান, সবজি, গম, আলু ও অন্যান্য শাকজাতীয় সবজি আবাদ হয়, এমন জমির মালিক কাউকেই চা চাষে উদ্বুদ্ধ করবেন না। পতিত ও অন্যান্য অকৃষি জমিতে চা চাষের জন্য বলেন কোন আপত্তি নাই। তা না হলে পঞ্চমগড় জেলা এক সময় বিরাণ ভূমিতে পরিণত হবে এবং পঞ্চগড় জেলার পরবর্তী বংশধরের ভবিষ্যৎ এইসব জমিতে অন্যান্য ফসল না হওয়ার কারণে অন্ধকারে ঢেকে যাবে, এইটি আমার একান্তই ব্যক্তিগত ধারণা। তাই সময় থাকতে আমাদের সচেতন হয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে বলে আমি মনে করি। আশা করি পঞ্চগড়ের সচেতন মহল, আপনারা বিষয়টি একটু গভীরভাবে ভেবে দেখবেন।

লেখকঃ
কৃষিবিদ মোঃ আববাস আলী
ডিরেক্টরঃ এক্সপ্লোর বিজনেস লিমিটেড।

Facebook Comments