নদী সুরক্ষায় ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন

- ৭ দফা গণদাবী উত্থাপিত

0
1123

গত ২৭ জুলাই ২০১৮, শুক্রবার, ময়মনসিংহের জয়নুল উদ্যানে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত হলো ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের দিনব্যাপী নদী সুরক্ষায় গণদাবী, গণশপথ ও সমাবেশ।

সকালে কর্মসূচির উদ্বোধন করেন কবি ও সংগীতশিল্পী কফিল আহমেদ। সমাবেশে বক্তব্য রাখেন ময়মনসিংহ পৌরসভার মেয়র ইকরামুল হক টিটু, গণতান্ত্রিক আইনজীবী সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি এ, এইচ, এম খালেকুজ্জামান, অধ্যাপক ডা: মতিউর রহমান, রিভারাইন পিপলের পরিচালক তুহিন ওয়াদুদ, জলবায়ু গবেষক রহমান রানা, জেলা সিপিবির সভাপতি এমদাদুল হক মিল্লাত, জেলা আওয়ালীগের সাধারণ সম্পাদক মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল, অধ্যাপক মাহফুজুর রহমান, গবেষক স্বপন ধর, লেখক অনুপ সাদী, পড়উআ সভাপতি ড. শাহাব উদ্দিন প্রমুখ।

ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলনের পক্ষে নদী সুরক্ষায় গণদাবী পাঠ করেন সমন্বয়ক আবুল কালাম আল আজাদ।

উত্থাপিত গণদাবী সমূহঃ

“নদীই প্রাণ, নদীই জীবন এবং আর সকল প্রাণ ও জীবনের আধার। নদীকে জাতীয় বা রাষ্ট্রীয় কিংবা ব্যক্তিগত সম্পদ মনে করবার মাঝ দিয়েই নদীবিনাশি যাবতীয় জবরদখল আর অত্যাচার চলছে দুনিয়া জুড়ে। আর সবচাইতে নিষ্ঠুরতম অত্যাচার আর জবরদখলের শিকার হচ্ছে আমাদের এই বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো। তন্মধ্যে পৃথিবীর অন্যতম প্রধান প্রাচীনতম নদ-নদীগুলোর একটি নদ আমাদের এই ব্রহ্মপুত্র অত্যাচার অনাচারের ছোবলে আজ মৃত্যুর সাথে লড়ছে। নানান অত্যাচারে অনাচারে জর্জরিত আমাদের এই ব্রহ্মপুত্রকে বাঁচাতে হলে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের সকল মানুষকে আজ সর্বাত্মক প্রাণ প্রতিজ্ঞা নিয়ে একযোগে ভূমিকা নেয়া ছাড়া কোনো গত্যান্তুর নেই।
সেই লক্ষ্যে ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষেরা জরুরি কয়েকটি গণদাবী নিয়ে ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষার এই সামাজিক সাংস্কৃতিক লড়াই শুরু করছি। মানুষের অংশগ্রহন আর নদীরক্ষার নব-নব চিন্তার সমন্বয়ে নদী তথা সামগ্রিক প্রাণপ্রকৃতির এই আন্দোলন আরো স্পষ্টতর হবে।

০১.নদী বলতে মূলত প্রাকৃতিকভাবে বয়ে চলা জলধারাকে বুঝায়। নদীর এই স্বাভাবিক বয়ে চলার পথে বিঘ্ন ঘটে, যেমন বাঁধ বা ড্যাম বিনির্মাণ, জলধারার বিঘ্ন ঘটায় এমন ব্রীজ বিনির্মাণ, বালু উত্তোলন, জলধারার স্বাভাবিক বয়ে চলার পথে এই তিনটি প্রধান অন্তরায়কে দূর করবার জন্য নদীর প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকেই পরিষ্কার নদীবান্ধব আইন, এবং সেই লক্ষ্যে পাড়ে পাড়ে সর্বসাধারণের নদীবান্ধব সজাগ ভূমিকা নিশ্চিত করা দরকার।

০২. ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষেরা মুলত কৃষিজীবি, মৎস্যজীবি। ব্রহ্মপুত্রের জলধারাকে কৃষি ও মৎস্যবান্ধব করার যথাযথ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ অতীব জরুরী। সেই সাথে নদী নির্ভর এ দেশের লুপ্তপ্রায় আরো নানান পেশাজীবি, যেমন মাঝিমাল্লা, মৃৎশিল্পী, তাঁতশিল্পী আবহমান বাংলার হারিয়ে যাওয়া নদীমাতৃক পেশাগুলিকে সমকালীন আর্থসামাজিক বাস্তবতার মূলধারায় ফিরিয়ে আনার বাস্তবিক উদ্যোগ ভূমিকা গ্রহণ জরুরী।

০৩. ব্রহ্মপুত্র নদীর বুকে, পাড়ে পাড়ে জন্ম নেয়া জীব জন্তু পাখপাখালিসহ জীববৈচিত্র্যের জন্য আবহমানকাল ধরে পাড়ে পাড়ে স্বভাবিক ভাবে জন্ম নেয়া লুপ্ত ঝোপজংগল বৃক্ষতরুলতার জন্মাবার অনুকূল পরিবেশ বিনির্মাণের যথাযথ উদ্যোগ গ্রহন জরুরী।

০৪. বাংলাদেশ অভ্যন্তরে ব্রহ্মপুত্র’র গতিধারা পথে যেখানে যেখানে চর বা যেখানে যেখানে গতিধারাপথে অচলাবস্থার প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছে তা সুনির্দিষ্ট করে তা সচল করবার জন্য নদীবান্ধব বাস্তবিক ভূমিকা জরুরি।
সেইসাথে ব্রহ্মপুত্র প্রণালীতে ইতোমধ্যে ছিন্ন হয়ে যাওয়া দেশের অন্যসব নদীপ্রবাহ বা প্রণালীর সাথে সংযোগের উদ্যোগ গ্রহন।

আন্তর্জাতিক নদী হিসাবে ব্রহ্মপুত্র যে সকল প্রতিকূলতার জন্য তার স্বাভাবিক গতিধারা হারিয়ে আজ বিচ্ছিন্নভাবে মরতে বসেছে, সেই কারনগুলির বাস্তবিক অনুসন্ধাণ, চিহ্নিতকরন এবং সেই গতিধারা ফিরিয়ে আনার জন্য জাতীয়ভাবে আন্তর্জাতিক ভূমিকাগ্রহণ জরুরি।

০৫. পৃথিবীতে নদীর মৃত্যু এবং দূষণের মারাত্মক কারন নদীহন্তারক কারখানা ও শিল্পবর্জ্য বা ক্যামিক্যাল দূষণ। ব্রহ্মপুত্রকে কারখানা প্রযুক্তির ছোঁবল থেকে বাঁচাতে হলে নদীর আশেপাশে অর্থাৎ কারখানাজাত ধোঁয়া বা ক্যামিক্যাল বর্জ্য যেনো কোনোপ্রকারেই পৌঁছাতে বা মিশতে না পারে সেই নিরাপদ দূরত্ব নিশ্চিত করতে হবে।

মৎস্যচাষের নিমিত্তে পুকুরের ক্যামিক্যাল, পাড়ের কৃষিজমিতে ব্যবহৃত সার বা ক্যামিক্যাল নদী দূষণের বড় কারন। সেই বিবেচনায় সজাগ ভূমিকাগ্রহণ জরুরি, যেনো নদীপাড়ের কৃষি জমিতেও যে কোনো ক্যামিক্যালজাত সার বিষ ব্যবহারের উপর রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক নিষেধাজ্ঞা জারি করতে হবে।
নদীজলের জন্য, এবং নদীজাত মাছের জন্য মারাত্মক হুমকি হচ্ছে পোড়া তেল মবিল ডিজেল। তাই, নদীতে ডিজেল ইঞ্জিন চালিত নৌকা, এবং পোড়া ডিজেল নি:সৃত হয় এমন যান্ত্রিক সেচব্যবস্থার ক্ষেত্রেও কঠোর সজাগ ভূমিকা নিতে হবে।

০৬. প্লাস্টিকজাত পণ্যের অধিক ব্যবহারের কারণে প্রাণ-প্রকৃতি-নদী আজ হুমকির মুখে। প্লাস্টিকজাত দূষণ থেকে নদীকে রক্ষার যথাযথ উদ্যোগ নিতে হবে।

০৭. দূরূহ এবং কঠিন হলেও ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষার জন্য উল্লেখিত উদ্যোগ ভূমিকা গ্রহনের এই সামাজিক সাংস্কৃতিক, পৃকৃত প্রস্তাবে নদীরক্ষার একটি সামাজিক বিজ্ঞানভিত্তিক এই উদ্যোগ নিতে আজ আমরা ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষেরা বাধ্য।
এইসব উদ্যোগ ভূমিকা কার্যকর করবার জন্য ব্রহ্মপুত্র পাড়ের মানুষেরা পাড়ে পাড়ে ‘ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা কমিউনিটি’ গড়ে তোলবার প্রস্তাব করছি।”

গণদাবীগুলো কয়েকটি ধাপে জনমত যাচাই, অভ্যন্তরীণ আলোচনা মূল্যায়নের পর চূড়ান্তভাবে লিখেছেন কবি ও সঙ্গীতশিল্পী কফিল আহমেদ

জমায়েত জনতার একাংশ

উত্থাপিত গণদাবীগুলোতে উপস্থিত জনতা বিপুল করতালির মাধ্যমে সমর্থন জানান এবং বিকালের আলোচনা পর্বে গণদাবী নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন।

সভায় বক্তারা বলেন, সবার আগে আমাদেরকে নদীকে বুঝতে হবে। আমাদের বর্তমান ও আগামী পৃথিবীকে সকল প্রাণের বাসযোগ্য রাখতে হলে নদীকে সুরক্ষা করতেই হবে। সকল ধরণের দখল, দূষণ ও নদী বিরোধী পদক্ষেপ রুখতে প্রয়োজনে গণআন্দোলন তৈরি করতে হবে।

সকাল থেকে নদী বিষয়ক চিত্রাঙ্কন ও রচনা প্রতিযোগিতায় প্রচুর শিক্ষার্থীর  অংশগ্রহণ, গান, কবিতা, আলোচনা এবং দৈত্যদল ও এফ মাইনরের কনসার্টে বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে মুখরিত থাকে।

উত্থাপিত গণদাবীর ভিত্তিতে ব্রহ্মপুত্র সুরক্ষা আন্দোলন আগামী দিনে সংগ্রাম জোরদার করবে।

© আবুল কালাম আজাদ।

Facebook Comments