বাহান্নর এক টগবগে তরুণের গল্প

0
2081
ভাষা সৈনিক এ বি এম জাকারিয়া।

বাহান্নর এক টগবগে তরুণের গল্প

ভাষা সৈনিক এ বি এম জাকারিয়া।

১৯৫২! বাঙ্গালি জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি বছরের নাম। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙ্গালিরাই প্রথম জাতি যারা ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছে।
বাহান্নতে যখন রফিক , শফিক, বরকতদের তাজা রক্ত রাস্তায়, ঠিক সেই সময়ে সর্বত্তোরের জনপদ পঞ্চগড়ের টগবগে তরুণেরাও নেমে পড়ে রাস্তায়। তরুণরাই যে সবজায়গায় সামনে ছিল তার প্রমাণ দেয় ৫২, ৬৬ কিংবা ৭১। পঞ্চগড়ে ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব যারা দিয়েছিল তাদের মধ্যে আমার জানা মতে বর্তমানে জীবিত একজনই। এটি তাঁর সেই বাহান্নর স্মৃতি কথা আর জীবনের কিছু স্মরণীয় দিন নিয়ে ছোট একটি লিখা মাত্র।

বায়ান্নোর সেই টগবগে তরুণের নাম এ বি এম জাকারিয়া। জন্ম পঞ্চগড়ের পাঁচ গড়ের এক গড় মীরগড়ে। ৫২ তে ১৪ বছরের টগবগে তরুণ ছিলেন । বাল্য শিক্ষা শুরু হয় মীরগড় জুনিয়র মাদ্রাসায়। পরবর্তীতে বিপি সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ে শুরু হয় হাইস্কুল জীবন। বাহান্নতে যখন দেশের রাজপথ মাতৃভাষা বাংলা চাই বলে কম্পিত , তখন তিনি বিপি হাইস্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র।
মাতৃভাষা বাংলা চাই আন্দোলন যখন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল তখন পঞ্চগড়ের কীর্তিমান ছাত্রনেতা ও ভাষা সৈনিক আব্দুল কাদেরের নেতৃত্বে সহযোদ্ধা আনোয়ারুল , জবেদ আলী সহ নাম না জানা আরও অনেকের সাথে রাজপথে নামেন এ বি এম জাকারিয়া। রেডিওর মাধ্যমে ডিসেম্বর বা জানুয়ারীর দিকে জানতে পারেন রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই নিয়ে তোলপাড় শুরু হচ্ছে। তরূণদের অংশগ্রহণে পঞ্চগড়ের রাজপথও হয়ে ওঠে উত্তাল। বর্তমান পঞ্চগড় পৌরসভার পিছনে করা হত মিটিং । পঞ্চগড়ের মূল নেতৃত্বে ছিলেন সাবেক আইন ও বিচার বিষয়ক মন্ত্রী মির্জা গোলাম হাফিজ। আর ছাত্রদের মধ্যে পঞ্চগড় বিপি স্কুলের ছাত্ররা ছিলেন একদম সামনে। তবে বাকি স্কুল গুলোতেও ক্লাস বন্ধ ছিল এবং ছাত্ররা ছিল ভাষা আন্দোলনের কর্মসূচিতে। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানি শাসকের তাবেদার যোগাযোগ মন্ত্রী হাছান আলীর পঞ্চগড় সফর বাতিলের জন্যে রাজপথে নামেন তিনি। উত্তাল রাজপথে স্লোগান দেন “ ফিরে যাও হাছান আলী” ! স্লোগান দেওয়ার জন্য পুলিশের রোষানলে পতিত হয়েছিলেন তিনি। ১৯৫৪ এ ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দিতে যান দিনাজপুর। হোস্টেলের সামনে পরীক্ষা দিয়ে এসে বসে ছিলেন। হুট করে দুই জন পুলিশ এসে তাকে তুলে নিয়ে যায় কোতয়ালী থানায় (দিনাজপুর)। ২৮ দিন জেল খাটেন তিনি। সাথে চলেছিল অনেক নির্যাতন। ১৯৫৪ সালে আর বসা হয়নি ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায়। ১৯৫৬ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় অংশ নিলেও অকৃতকার্য হয়েছিলেন।

১৯৫৭ সালে নেমে আসল তাঁর জীবনে একটি কালো অধ্যায়। বাবার মৃত্যুর কারণে ধরতে হয় সংসারের হাল। ৭ ভাই বোনের সংসারে তিনি ছিলেন ভাইদের ২য়। শক্তহাতে ধরেন সংসারের হাল। পড়াশুনা বন্ধ হয়ে যায় তাঁর! উপার্যনের জন্য বেড়িয়ে পড়েন তিনি। দিনাজপুর , পঞ্চগড়ের বিভিন্ন ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানে তিনি হিসাব নিকাশের চাকুরী নেন।
১৯৫৭ সাল ! জীবনে আসল একটি চিরস্মরণীয় একটি দিন । বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন জমিলা বেগমের সাথে। ৩ পুত্র আর ১ কন্যার জনক তিনি।

স্বাধীনচেতা জাকারিয়ার ভালো লাগে নি ব্যক্তিমালিকানাধীন চাকরি। ১৯৬৮ সালে সমবায় সমতির ইউনিয়ন ম্যানেজার পদে চাকুরি পান তিনি। পরবর্তীতে পঞ্চগড় কেন্দ্রীয় আখচাষী সমবায় সমিতির হিসাব সংরক্ষনের চাকুরি করেন তিনি।
চাকুরি চলাকালে তিনি ১৯৬৯ সালে এস এস সি পাশ করেন। ১৯৭১ এ মুক্তিযোদ্ধে স্বপক্ষে কাজ করেন তিনি। ১৯৭২ সালে পাশ করেন এইচ এস সি..

অনেক কথা হয়েছিল এই মানুষটার সাথে ১৯৫২, ১৯৫৪, ১৯৫৯, ১৯৬৬, ১৯৭০, ১৯৭১ সাল নিয়ে। বলছিলেন আন্দোলন সংগ্রামের কথা গুলো। রাজপথে তরুণদের উপস্থিতি নিয়ে। ৮০ বছরের এই প্রবীণ ভুলে গিয়েছেন বেশির ভাগ স্মৃতি। তাঁর কাছে শুনেছিলাম আন্দোলন সংগ্রামে সামনে থাকা মানুষগুলোর বর্ণনা । কি এক অসাধারণ অনুভূতি! তাদের মত কিছু মানুষের জন্য আজ প্রাণ খুলে বাংলায় কথা বলি আমরা।
“মৃত্যুর প্রহর গুনি। মসজিদ আর বাড়ি এখন ঠিকানা। তবে ২০১৮ তে এসেও বলি আজও সারা দেশের ভাষা সৈনিকদের একটা তালিকা বের হল না। পেলাম না কোন স্বীকৃতি। সবাই শুধু স্মরণ করে ভাষার মাসেই। এর পর কারও খোঁজ থাকেনা। ভাষার জন্য রক্ত দেওয়া মানুষদের দিকে সরকারের দৃষ্টি চাই আজও” বলছিলেন এ বি এম জাকারিয়া

আসলেই হয়তো বাহান্ন না এলে অনেক কিছু অপরিপূর্ণ থেকে যেত আমাদের। সকল ভাষা সৈনিকদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা। রফিক , শফিক, বরকতদের আত্মাগুলো ভাল থাকুক। আল্লাহ তাদের জান্নাতবাসী করুক- আমীন।

আসুন ২১ কেন্দ্রিক নয় সারা বছর চলুক বাংলা ভাষার চর্চা।

লেখা ও ছবিঃ
মির্জা মিকাইল আবরার।

Facebook Comments