হাইব্রিড ধান চাষে কৃষকের অনীহা

0
2018

বাংলাদেশের হাইব্রিড ধান চাষের চিত্রটির দিকে তাকালে দেখা যাবে, এটির শুরু হয়েছিল ১৯৯৩ সালে IRRI’র( International Rice Research Institute) সাথে BRRI’র (Bangladesh Rice Research Institute) collaboration- এর মাধ্যমে। এরিয়া কভারেজের দিকে তাকালে দেখা যাবে বাংলাদেশে প্রায় ০.৬৮ মিলিওন হেক্টর(উৎসঃ BBS-2016)বা ৬ লক্ষ ৮০ হাজার হেক্টর জমিতে হাইব্রিড ধানের চাষ হয় অর্থাৎ ৬% জমিতে হাইব্রিড ধান এবং ৮২% জমিতে HYV বা হাই ইল্ডিং ভ্যারাইটির ধান এবং ১২% জমিতে লোকাল জাতের ধান চাষ হয়। বাংলাদেশে হাইব্রিড ধানের মার্কেট সাইজ প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টনের মত, মোটা ও চিকন মিলে অর্থাৎ সরকারী ,প্রাইভেট ও বিভিন্ন এনজিও সবাই মিলে এই পরিমাণ হাইব্রিড ধানের বীজ কৃষক পর্যায় বিক্রি করে । আবার এই ১০ হাজার মেট্রিক টনের মধ্যে ৯০% হাইব্রিড ধান চাষ হয় হয় বোরো মৌসুমে।আমনে দুই একটি ছাড়া সেই রকম কোন জনপ্রিয় জাত কৃষকের হাতে পৌঁছায়নি। ফলে আমনে হাইব্রিড ধান চাষের পরিমাণ খুবই কম। আমরা জানি বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪৭.২৬ মিলিওন মেট্রিক টন ধানের দরকার হয়(উৎসঃ BBS-2016)। এর পরিমাণ দিন দিন বাড়তেছে; কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে এর একটি ডিরেক্ট সম্পর্ক আছে। বাংলাদেশে হাইব্রিড ধান চাষ বাড়ার কারণগুলি যদি আমরা লক্ষ্য করি তাহলে দেখবো যে প্রতি নিয়ত ধান চাষের এরিয়া কমে যাচ্ছে, জনসংখ্যা দিন দিন বাড়তেছে, লোকাল ও HYV বা হাই ইল্ডিং ভ্যারাইটির তুলনায় ২০-২৫% ফলন বেশী, মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করাও জুরুরী, গড় প্রোডাক্টিভিটিতেও আমরা প্রায় অনেক পিছিয়ে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ স্থানে।এশিয়ার দেশগুলির তুলনায় ৫ম স্থানে।প্রথম স্থানে আছে অস্ট্রেলিয়া এদের গড় ফলন ৮.৭ মেট্রিক টন/ হেক্টর, বাংলাদেশের ৩.৭ মেট্রিক টন/ হেক্টর এবং সর্বনিম্নে আছে কম্বভোডিয়া যাদের গড় ফলন ২.৩ মেট্রিক টন/ হেক্টর। এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে প্রথম জাপান, দ্বিতীয় চীন, তৃতীয় ভিয়েনতনাম, চতুর্থ ইন্দোনেশিয়া , ৫ম বাংলাদেশ, ৬ষ্ঠ মায়ানমার,৭ম ফিলিপিন্স,৮ম মালয়শিয়া,৯ম পাকিস্তান, ১০ম ইন্ডিয়া,১১ম স্থানে থাইল্যান্ড। অর্থাৎ ধানের গড় প্রোডাক্টিভিটি বাড়ানো,রোগ বালাই মুক্ত জাত কৃষককের হাতে তুলে দেওয়া বিভিন্ন কারণে হাইব্রিড ধান চাষের কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হচ্ছিল । বাংলাদেশে ১৯৯৮- ২০১০সাল পর্যন্ত ৮৫টি হাইব্রিড ধানের জাত NSB বা ন্যাশনাল সীড বোর্ড কর্তৃক অনুমোদিত হয়েছে,এর মধ্যে ৮০টি প্রাইভেট সেক্টর আর ৫টি পাবলিক সেক্টর। যার কারণে গত কয়েক বছরে হাইব্রিড ধানের বীজের মার্কেট সাইজ বেশ বাড়তেছিল কিন্ত এবছর বোরোতে হাইব্রিড ধানের বীজের প্রতি কৃষকের আহামরি তেমন কোন আগ্রহ দেখলাম না। বিভিন্ন এলাকার কৃষক যেমন- যশোর, খুলনা, কুষ্টিয়া ,চুয়াডাঙা, নাটোর, গাইাবান্ধা, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ ও কিশোরগন্জের কৃষকের সাথে কথা বলে দেখা গেছে, হাইব্রিড ধানের বীজের প্রতি কৃষকের তেমন কোন চাহিদা নাই। নানা কারণে কৃষকরা হাইব্রিড ধান চাষ থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। ইনব্রিডের তুলনায় হাইব্রিড ধানের দাম কম, মিল মালিকের কাছে হাইব্রিড ধানের চাহিদা কম; কারণ গ্রেইন সাইজ ভালো না বলে তারা নানা কারণ দেখায়। বেশীর ভাগ সময় ইনব্রিড ২৮,২৯ জাতের তুলনায় ফলন কম কিন্ত পরিচর্যা করতে হয় বেশী। দামের বেলাতেও তারা তেমন কোন পার্থক্য পান না অর্থাৎ লাভের অংশ খরচের তুলনায় খুবই কম। এমাইলোজের % শতকরা ২৫ভাগের নীচে থাকায়, ভাতের গুনাগুনও ভালো না, ভাত আঠালো হয়ে যায়, পান্তা খাওয়া যায় না, তাছাড়া বাজারে বেশীর ভাগ মোটা জাতের হাইব্রিড ধানের বীজ পাওয়া যায়,যা অধিকাংশ চাইনিজ সোর্স। চিকন জাতের পরিমাণ অতি সামান্য। টি.আউশ ও টি. আমনের হাইব্রিড ধানের বীজ ২/১টি ছাড়া নাই বল্লেই চলে। তাছাড়া হাইব্রিড ধানের অথনৈতিক পারফর্মেন্স কতগুলি বিষয়ের উপর নির্ভর করে, যেমন- হাইব্রিড ধানের প্রোডাক্টিভিটি, হাইব্রিড ধানের দাম, গ্রেইন সাইজ ও কোয়ালিটি, কঞ্জুমার একসেপ্টেন্স, এডাপ্টিবিলিটি, কোয়ালিটি বীজ সাপ্লাই, প্রোডাক্টশন ইনপুটস এভ্যাইলেবিলিটি ও মূল্য, লেবার এভ্যাইলেবিলিটি ও ব্যয়, আর ও আই, রোগ বালাই, পোকা মাকড়, ঝর বৃষ্টি ও বন্যা ইত্যাদি। উপরোক্ত কারণগুলির মধ্যে হাইব্রিড ধানের বাজার মূল্য সবচেয়ে বেশী নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও হাইব্রিড ধান বীজের ক্রয়মুল্য বেশী, চিকন জাতের অভাব, মাঝে মাঝে জার্মিনেশন সমস্যা, গাছের উচ্চতা ও লেট ম্যাচুরিটি ,ঝরে পড়া ও ঢলে পড়া, গ্রেইন টাইপ লম্বা না হওয়া, ঝরঝরা ও সুস্বাদু না হওয়ার কারণেও কৃষকরা ইদানিং হাইব্রিড ধান চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। ফলে যে সব কোম্পানী হাইব্রিড ধান বীজ বিক্রয়ের সাথে জড়িত তাদের একটু সতর্কতার সাথে অগ্রসর হতে হবে বলে আমি বিশ্বাস করি। আশা করি সকল কোম্পানী ও সংশ্লিষ্ট বিভাগ বিষয়টি গভীরভাবে ভাববেন এবং সামনের মৌসুম গুলুতে কীভাবে কৃষকের আগ্রহ ফিরিয়ে আনা যায়, সেইভাবে ব্যবস্থা নিবেন। তাহলেই কেবল- THE MAN WHO PUTS AN END TO HUNGER. Yuan Longping, “Father of Hybrid Rice” উনার হাইব্রিড ধান আবিষ্কারের মাধ্যমে মানুষের জন্য ক্ষুধা মিটানোর স্বপ্ন পূরণ হবে।

লেখকঃ
কৃষিবিদ মোঃ আববাস আলী
পরিচালকঃ এক্সপ্লোর বিজনেস লিমিটেড।

Facebook Comments